চট্টগ্রাম, ১৩ ফ্রেব্রুয়ারি, ২০২৫:
এক:
বাংলা ভাষা, বাংলার সংস্কৃতি, কিম্বা বাঙালর অতীত ইতিহাসের সঙ্গে ইসলামের কোন আজগবি বিভক্তি বা বিভাজন নাই, বরং এই অঞ্চলে ইসলামের আবির্ভাব ও ইতিহাস বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। আমরা হঠাৎ নাজিল হই নি। উভয়ের মধ্যে কোন আকস্মিক ছেদ বা ভেদবিন্দু নাই, তবে ওইতিহাসিক ঘটনা পরিক্রমা, পারস্পরিকতা, বিবর্তন বা রূপান্তর আছে।
ধর্মপ্রাণ মানুষ সহজে বুঝবেন যে আমরা আল্লার ইচ্ছার অধীন, যিনি নিত্য গায়েব এবং তাঁরই তরফে এবং শুধুমাত্র তাঁরই ইছায় বাংলাদেশের জনগণ স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠি হিশাবে এই বিশ্ববাগানে হাজির। একই সত্য অন্য জাতিগোষ্ঠির ক্ষেত্রেও সত্য। অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সঙ্গে এবং তাদের পাশাপাশি ‘বাঙালি’ জনগোষ্ঠি প্রত্যেকেই প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ অনুযায়ী মানবিক রুহানি বিকাশের ঐতিহাসিক পরিণতি। নিজ নিজ স্বাতন্ত্র ও ঐতিহাসিক বিবর্তন আল্লার সৃষ্ট প্রতিটি জাতিগোষ্ঠি উপলব্ধি করে এবং বোঝে বলেই ছোটবড় সকল জাতিগোষ্ঠির স্বাতন্ত্র্য ও বিবর্তনও ইসলাম স্বীকার করে।
না, আমরা আল্লার ওপর খোদকারি করি না। তাই এই স্বাতন্ত্র্য, ও বৈচিত্র্য যারা মুছে দিতে চায়, নিজেদের মতো সকলকে যারা একই ছাঁচে পর্যবসিত ও একাকার করতে চায়, ইসলাম তা মানতে পারে না। আমরাও তার বিরোধিতা করি। – বৈচিত্রের বিলোপ ও নিরাকরণ ঘটানো খোদ সৃষ্টিকর্তারই বিরোধিতা। স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্য আল্লার দেওয়া দান,অতএব সকল জাতিগোষ্ঠির মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকার আমরা কবুল করি।
দুই:
ইতিহাস সরলরৈখিক কোন বিষয় না। বাংলাভাষী ও বাঙালিদের স্বাতন্ত্র্য এবং বিশেষ বিশেষ অর্জন নানান দিক থেকে বিচার করে দেখা জরুরি। সেই দিক থেকে বাংলাদেশে ইসলামের বহুস্তরীয় ও জটিল ইতিহাস একই সঙ্গে আমাদের ‘বাঙালি’ হয়ে ওঠার ইতিহাসও বটে। কথাটা অন্য ভাবেও বলা যায়। বাঙালির ইতিহাস একই সঙ্গে আমাদের ইসলাম কিম্বা ইসলামের সার্বজনীন মর্ম ও মহিমার অন্তর্ভূক্ত হয়ে ওঠার ইতিহাস। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে সে কারনে ইসলামের বিরুদ্ধে, কিম্বা ইসলামকে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি কিম্বা আমাদের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক চেতনার বিপরীতে দাঁড় করানো এবসার্ড ব্যাপার। চরম স্টুপিডিটি। বাঙালি জাতিবাদ এই আত্মঘাতী ভুল করেছে। শেখ হাসিনার দিল্লীতে পল্যনের মধ্য দিয়ে সেই ভুলের খেসারত দেওয়াই আমরা দেখলাম।
তাহলে এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার যে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা ‘মুসলমান’বনাম ‘বাঙালি’ হওয়ার আইডেন্টিরিয়ান বিভক্তিমূলক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসেছি। ধর্ম বনাম সেকুলার মার্কা বাইনারির বাইরে ছাত্র-জনতার নেতৃত্ব বাংলাদেশের জনগণ সম্পর্কে নতুন ভাবে ভাবতে পারছে। ভাবতে পেরেছে বলেই আমরা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে উৎখাত করতে পেরেছি। এই বাইনারির পূর্ণাঙ্গ দাফন এখন দোয়াদরূদ পড়ে সাড়ম্বরে দ্রূত বিদায় দিতে হবে। এটাই আমাদের এখনকার প্রধান কর্তব্য। এর মধ্য দিয়ে ইসলামকে ইন্দো-মার্কিন-ইজরায়েলি পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি জাতিবাদী পরিচয়সর্বস্ব ফ্যাসিস্ট মতাদর্শে পর্যবসিত করবার রাজনীতি থেকে আমরা মুক্ত হয়ে যাব, ইনশাল্লাহ।
একাত্তরে আমরা নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছি। একাত্তরের পর ‘বাঙালি’ বলতে রাজনৈতিক অর্থে শুধু বাংলাদেশের জনগণকেই বোঝায়। সীমান্তের ওপারে আছেন বাংলাভাষী ভারতীয়, আমরা তাঁদের ভালবাসি এবং শ্রদ্ধা করি। হিন্দুত্ববাদী ভারতের নাগরিক হওয়া, দিল্লির পরাধীন থাকা এবং হিন্দি, হিন্দু ও হিন্দুস্তানের মধ্যে নিজেদের স্বাধীন সত্তা বিলীন করে দেওয়া তাঁদের অমোঘ নিয়তি কিনা সেটা তাঁরাই ভেবে দেখবেন। সেটা তাঁদেরই অধিকার ।
তিন:
ইতিহাস ও রাজনৈতিকতার মর্ম যদি আমরা বুঝি তাহলে ‘বাঙালি মুসলমান’ নামক কোন কৃত্রিম, কাল্পনিক ও হাইব্রিড জনগোষ্ঠি নাই, কারন একাত্তরের রাজনৈতিক মর্ম ‘বাঙালি’ হিশাবে নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা প্রতিষ্ঠা। ভারতীয় বাণফালিদের বিপরীতে আমাদের এই বাঙালি হয়ে ও ঠা কখনই ইসলাম বিবর্জিত ছিল না। ইসলাম সদা সর্বদাই আমামদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সত্তার অন্তর্গত, ছিল এবং রয়েছে। বাংলায় স্বাধীন সুলতানদের আমল থেকে এই ভূখণ্ডে ইসলাম এসেছে এবং আমাদের বাঙালি হয়ে ওঠার ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত।
একাত্তরে লক্ষ লক্ষ শহিদ হয়ে এদেশের জনগণ ‘বাঙালি’ হিশাবে নিজেদের যে রাজনৈতিক সত্তা কায়েম করেছে অনিবার্য ঐতিহাসিক কারণেই ইসলাম তার অন্তর্নিহিত শক্তি হিশাবে হাজির ছিল। যখনই তাকে বাঙালি জাতিবাদীরা অস্বীকার করবার চেষ্টা করেছে এদেশের জনগণ তা মেনে নেয় নি। বাঙালি জাতিবাদীদের এই চেষ্টার বিপরীতেই জাতিবাদী পরিচয় সর্বস্ব ইসলামি ধারা গড়ে উঠেছে। যারা আমাদের ভাষা , সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সত্তার বিপরীতে নতুন করে আমাদের ‘মুসলমান’ বানাতে চায়। সেটা করতে গিয়ে তারা আমাদের সৌদি, ইরানি, তুরানি ইত্যাদি বানাতে চায়। আল্লাহ আমাদের সৌদি, ইরানি, তুরানি, মিশরি, আজারবাইজানি, তাজিকি ইত্যাদি বানাতে চাইলে সেইসব দেশেই আমাদের জন্ম পয়দা করতেন।
তাই মনে রাখবেন আমরা কোন হাইব্রিড জাতি বা জনগোষ্ঠি না। আমরা বিশ্ব সভায় নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে হাজির হয়েছি। অতএব আমাদের ভূরাজনৈতিক ও বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গীও ঐতিহাসিক কারণে অন্যান্য দেশের মানুষের থেকে আলাদা। আমরা পাকিস্তানের জালিম শাহীকে উৎখাত, পরাজিত ও বিতাড়িত করেছি। দিল্লির বিরুদ্ধেও লড়াই চলবে, অথবা দিল্লিকে বদলাতে হবে। নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমরা অকাতরে জীবন দিয়েছি। শহিদ হয়েছি।
মনে রাখুন, একাত্তরে আমরা রক্ত দিয়ে ‘বাঙালি’ হয়েছি।
একাত্তর আমাদের জন্মচিহ্ন, আমাদের বৈশ্বিক আবির্ভাবের মুহূর্ত। একাত্তর নন-নেগোশিয়েবল।
চার:
রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে আমাদের আবির্ভাব তথাকথিত বাঙালি জাতিবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা কায়েম করবার জন্য নয় , আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল ইসলামের সার্বজনীন আদর্শের সঙ্গে অতিশয় সঙ্গতিপূর্ণ: সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ইনসাফ (বা সামাজিক ন্যায়বিচার)। ইসলাম কিভাবে আমাদের রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠছে তা এক অভূতপূর্ব নজির। স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একদিকে যেমন ‘বাঙালি হয়েছি, বা আমাদের রাজনৈতিক সত্তাকে ‘বাঙালি হিশাবে চিহ্নিত করেছি তেমনি সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি ইসলাম জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে না। আল্লাহ দুনিয়ায় বিভিন্ন ভূগোলে বিভিন্ন জাতি, ভাষা, সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন যেন স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠি হিশাবে মানবজাতি পরস্পরকে চিনতে পারে।
জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর একাত্তরের মর্ম আমাদের নতুন করে উপলব্ধি ও বিচার করতে হবে। একাত্তরে আমরা জালিমের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে প্রমাণ করেছি ইসলাম মজলুমের ধর্ম। আমাদের সেনাপতি রসুলে করিম মোহাম্মদ (সা), এবং আমরা তাঁর উম্মত বলেই ইসলামকে যারা জালিমের মতাদর্শ ও বর্ম হিশাবে ব্যভার করেছে তাদের উপযুক্ত জবাব দিয়ে দিয়েছি। ঠিক রেমনি ইসলামের নামে যারা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলেন আশা করি তারা সিধা হয়ে যাবেন। ইসলাম জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের দ্বীন, একাত্তরে আমরা সেই সত্যই কায়েম করেছি।
এই উপলব্ধি আমরা গভীর করতে পেরেছি বলেই গণঅভ্যুত্থান সম্ভব হয়েছে কারণ আমরা ইসলাম বনাম তথাকথিত সেকুলারজমের কৃত্রিম ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত বিভাজন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছি। তাকে আবার ফিরিয়ে এনে আগ্রাসী দিল্লী ও হিন্দুত্ববাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করবেন না। আর যারা ইসলামের নামে মাজারের পর মাজার ভেঙে উম্মাহকে বিভক্ত করছেন, আপনারা হিন্দুত্ববাদী দিল্লি ও ইজরায়েলের স্বার্থ উদ্ধার করে চলেছেন, আশা করি আপনারাও ভাববেন আপনারা কার স্বার্থে কাজ করছেন।
আমরা যেন বিবেক বর্জিত না হই।।