চট্টগ্রাম,৫ নভেম্বর,২০২২:
সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) এলাকায় হাসপাতাল গড়ার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের লাগাতর আন্দোলনে এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের জনগণের দাবির গুরুত্ব অনুধাবন করে সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প থেকে সরে আসে সরকার। যে কারণে এই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণা করবে আজ চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ। তাদের দাবি মেনে নেয়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আন্দোলনের সমাপ্তি ঘোষণায় মহাসমাবেশ আয়োজন করেছেন আজ শনিবার দুপুরে।
সিআরবি রক্ষা আন্দোলনে নাগরিক সমাজের সাথে ছিলেন আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতৃবৃন্দও। অন্যদিকে সিআরবিতে হাসপাতাল বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের যৌক্তিকতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরেন আওয়ামী লীগে চট্টগ্রামের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি।
জানা গেছে আজকের সভায় তিনি সহ তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল উপস্থিত থাকবেন। যাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা সিআরবিতে এনে দিয়েছে সফলতা। সিআরবিতে হাসপাতালবিরোধী এই আন্দোলন সংগ্রামে সাংবাদিক, পেশাজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিককর্মীসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।
আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত নেতৃবৃন্দ ও নগরবাসীর পর্যবেক্ষণ- সিআরবি রক্ষার আন্দোলনে নগরীর বিশিষ্টজনদের হাত ধরে যাত্রা শুরু করলেও যৌক্তিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে নেপথ্যে অভিভাবকতুল্য ভূমিকা রেখেছেন ড. অনুপম সেন এবং চট্টগ্রামবাসীর চাওয়ার কথাটাকে সরকারের শীর্ষ মহল বিশেষতঃ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করেছেন জ্যেষ্ট নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তাদের দু’জনের অভিভাবকত্বে সিআরবি রক্ষার আন্দোলন এগিয়ে গেছে অনিবার্য সফলতার দিকে।
চট্টগ্রামবাসীর এ আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল, ডা. মাহফুজুর রহমান, ড. ইদ্রিস আলী, মফিজুর রহমান, এডভোকেট ইফতেখার সাইমুলসহ নগরের সর্বস্তরের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবর্গ।
অপরদিকে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি এলাকায় বাণিজ্যিক হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরকারের উচ্চ মহলের নজরে এনেছেন ক্ষতিকর দিকগুলো।
এই বিষয়ে নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল জানান, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছিলেন, চট্টগ্রামের মন্ত্রী-এমপিরা না চাইলে সিআরবিতে হাসপাতাল হবে না। এরপর সিআরবি থেকে হাসপাতাল সরিয়ে নিতে গত ১৬ অগাস্ট সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল চট্টগ্রামের মন্ত্রী-এমপিদের সাক্ষরিত একটি চিঠি রেলমন্ত্রীকে দেন।
তিনি আরো বলেন, এর দুয়েকদিনের মধ্যেই রেলমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা হয়। প্রধানমন্ত্রী তখন জানিয়ে দেন, পাবলিক সেন্টিমেন্টের বাইরে গিয়ে সিআরবিতে কিছু করা হবে না। সিআরবি রক্ষায় টানা ৪৮০ দিনের কর্মসূচি এই মহাসমাবেশের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রাম নগরীর ‘ফুসফুস’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ঐতিহ্যবাহী সিআরবিতে পিপিপি প্রকল্পের আওতায় ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য ২০২০ সালের ১৮ মার্চ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সাথে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত বছরের জুলাই মাসে প্রকল্প এলাকার জমি হাসপাতাল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলে প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু হয়। সিআরবিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) এই হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ১২ বছর। প্রকল্পের আওতায় ৫০ আসনের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণেরও প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবনা অনুসারে, এতে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়। ৫০ বছর পর প্রকল্পের মালিকানা রেলওয়ের হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে।
সিআরবিতে আন্দোলনের এক পর্যায়ে রেলমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এছাড়া এ সংক্রান্ত এক চিঠিতে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, হুইপ শামসুল হক চৌধুরী, মোছলেম উদ্দিন আহমেদ এমপি, মোস্তাফিজুর রহমান এমপি, মাহফুজুর রহমান মিতা এমপি, খাদিজাতুল আনোয়ার সনি এমপিও স্বাক্ষর করেন। দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে ঐতিহাসিক সিআরবি এলাকায় পিপিপির আওতায় হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পটি রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সীতাকু-ের কুমিরায় স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয়।
চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত কেন্দ্রীয় রেলভবন তথা সিআরবি হচ্ছে চট্টগ্রাম নগরীর এক খণ্ড মুক্ত এলাকা। বিশাল জায়গাজুড়ে নানা গাছপালাগুলো দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়-টিলায়। এখানে রয়েছে অসংখ্য রেইনট্রি। যেগুলোর কোনো কোনোটির বয়স পেরিয়ে গেছে শত বছরের বেশি। এটি ব্যস্ততম নগরী চট্টগ্রামের অক্সিজেন সরবরাহের উৎস হিসেবেও পরিচিত।
সম্প্রতি এক গবেষণায় সিআরবিতে প্রায় ২২৫টি দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। শতবর্ষী বৃক্ষরাজি, পাহাড়, টিলা ও উপত্যকায় ঘেরা বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যম-িত স্থান হিসেবে সিআরবি চট্টগ্রামের মানুষের মনে আলাদা স্থান করে নিয়েছে। এখানে বৃক্ষরাজির শীতল ছায়াতলে বিশেষ করে অনিন্দ্যসুন্দর শিরীষতলায় আয়োজিত হয় বাংলা নববর্ষ, বসন্ত উৎসব, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীসহ বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহ।
তবে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে চট্টগ্রামবাসী তাদের আন্দোলনের ইতিবাচক ফল পেয়ে এখন উচ্ছ্বসিত। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞও। এই স্বস্তি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যই আজকে সিআরবির শিরিষ তলার অনুষ্ঠান। ছবি: সংগ্রহ