চট্টগ্রাম, ১০ আগস্ট, ২০২৩:
বৃহত্তর চট্টগ্রামে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে একের পর এক লাশ উদ্ধারের খবর আসছে। যারা বন্যায় নিখোঁজ ছিলেন তারা অনেকেই স্বজনদের কাছে লাশ হয়ে ফিরছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামে নিখোঁজদের মধ্যে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ছাইফুল্লাহ মজুমদার সংবাদ মাধ্যমকে জানান, এখন পর্যন্ত বন্যায় চট্টগ্রামের পাঁচ উপজেলায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন তিনজন। নিহতদের মধ্যে সাতকানিয়ায় ৬, লোহাগাড়ায় ৪, চন্দনাইশে ২, বাঁশখালী ও রাউজানে একজন করে এবং চট্টগ্রাম মহানগরে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সাতকানিয়ায় নিখোঁজ ৩ জনের খবর এখনো জানা যায়নি।
বন্যায় কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বিভিন্নস্থানে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উপজেলার লক্ষ্যারচর, বরইতলী, মানিকপুর, বিএমচর ইউনিয়নের বহদ্দার কাটা, পূর্ব বড় ভেওলা, বদরখালী ও খুটাখালী ইউনিয়নে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
বৃহস্পতিবার রাঙমাটি পৌর এলাকা, সাজেকের মাচালং এবং বাঘাইছড়ির করেঙ্গাতলী ও খেদারমারা ইউনিয়নে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এরা হলেন বাঢ়াইছড়ি পৌর এলাকার মহসিনের সন্তার জুয়েল(৭),বাঘাইছড়ির উপজেলার করেঙ্গাতলী ইউনিয়নের রাহুল বড়ুয়া(১০),খেদারমারা ইউনিয়নের হীরারচর এলাকার জুনি চাকমা(৭),সাজেকের মাচালং এলাকায় কাওলা ত্রিপুরা (৪০)। এছাড়া নানিয়ারচরে এক্ক্যোইয়া চাকমা (৮০) ও বরকলে নৌকা ডুবে মারা যায় সুমেন চাকমা (১৯)।
চকরিয়ায় গত সোমবার (৭ আগস্ট) মাতামুহুরী নদীর লক্ষ্যারচর পয়েন্টে ঢলের পানিতে লাকড়ি ধরতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিখোঁজ হয় শাহ আলম (৩৫) নামে এক যুবক। দুই ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলের সামন্য অদূরে ভাসমান অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার হয়। একইদিন দুপুরে বরইতলী ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব মৌলভী পাড়া সংলগ্ন সবুজ পাড়া এলাকায় পাহাড় ধ্বসে ঘরের মাটির দেয়াল চাপায় ঘুমন্ত অবস্থায় মারা যায় একই পরিবারে দুই শিশু সন্তান মো. সাবিদ (৫) ও তাবাচ্ছুম (১)।
বুধবার (৯ আগস্ট) সকাল ৯টার দিকে মানিকপুর এলাকা থেকে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যাওয়া আনোয়ার হোসেন (৭০) নামে এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার হয়। নিহত আনোয়ার হোসেন এর আগের দিন সকাল থেকে নিখোঁজ ছিলেন।
অপরদিকে পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড হাজী রওশন আলী পাড়া এলাকায় রেললাইনের কালভার্ট থেকে বন্যার পানিতে ঝাঁপ দিয়ে নিখোঁজ হয় মো. আসিফ (১২) নামে এক শিশু। এখনো তার এখনো খোঁজ মেলেনি।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১০ আগষ্ট) বেলা ১২টার দিকে বদরখালী ইউনিয়নের গোঁয়াখালী এলাকা থেকে বন্যার পানিতে ভাসমান অবস্থায় মো. জিহান (১২) নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার হয়েছে। একইদিন দুপুরে চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী এলাকা থেকে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির ভাসমান লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মরদেহ সনাক্তের জন্য সকলের সহায়তা চেয়েছেন থানা পুলিশ।
বিএমচর ইউনিয়নের উত্তর বহদ্দারকাটা এলাকায় বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়া সেফটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে বিষাক্ত গ্যাসে দম বন্ধ হয়ে মর্মান্তিভাবে নিহত হয় একই পরিবারের বাবা ও দুই ছেলেসহ তিনজন। নিহতরা হলেন, গৃহকর্তা আনোয়ার হোসেন (৬৭), তার ছেলে শাহাদাত হোসেন (৪৫) ও শহিদুল ইসলাম (২২)। তারা সবাই ওই এলাকার বাসিন্দা।
চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাবেদ মাহমুদ বলেন, গত এক সপ্তাহের বন্যায় পানিতে ডুবে, পাহাড় ধ্বসে ও সেফটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রামে বুধবার বিকেলে চন্দনাইশের দোহাজারি এলাকা থেকে এক বৃদ্ধ ও শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সম্পর্কে তারা দাদা-নাতি।
নিহতরা হলেন- বাঁশখালীর বাসিন্দা ৮১ বছর বয়সী আবু সৈয়দ এবং তার ১২ বছর বয়সী নাতি আনাস। তারা মঙ্গলবার সকালে চন্দনাইশ থেকে বাড়িতে যাওয়ার পথে পানিতে তলিয়ে যান।
সোমবার বিকেল ও রাতে লোহাগাড়ার আমিরাবাদে এক কৃষক আসহাব মিয়া ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জুনায়েদুল ইসলাম জারিফ বন্যার পানিতে তলিয়ে নিখোঁজ হন। মঙ্গলবার জারিফের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বুধবার সকালে উদ্ধার হয় আসহাব মিয়ার মরদেহ।
সাতকানিয়া উপজেলার চরতি ইউনিয়নের ৭ ওয়ার্ডের একই পরিবারের ৪ জন নৌকাযোগে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য বের হলে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়।
নিখোঁজ চারজনের মধ্যে জান্নাতুল ফেরদৌস নামের শিশুটির মরদেহ শঙ্খ নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে সাতকানিয়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সতিপাড়ার বাসিন্দা মো. রফিকের ১৬ বছরের ছেলে সাইদুল ইসলাম নাবিল মাদ্রাসার উদ্দেশে বের হয়ে নিখোঁজ হয়।
একই পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের গোয়াজর পাড়া এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ৫৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইদ্রিস।
নিখোঁজ মোহাম্মদ ইদ্রিসের ভাতিজা রেজাউর রহমান বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) মাগরিবের সময় বিকেল ৬টার দিকে সাতকানিয়া কলেজের পাশের ব্রিজ (স’ মিল) এলাকায় পা পিছলে পড়ে গেলে তীব্র স্রোতে ভেসে যান মোহাম্মদ ইদ্রিস।
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘সাতকানিয়া উপজেলায় ৬ জন নিহত ও ৩ জন নিখোঁজ ছিল। বিকেলে নিখোঁজ তিনজনের মধ্যে একজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। এখন নিহত মোট ৭ জন ও নিখোঁজ ২ জন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা আজকে তিনজনের মরদেহ উদ্ধারের খবর পেয়েছি। এই সংখ্যা হয়ত আরও বেশি, কিন্তু নেটওয়ার্কের কারণে সব খবর আমরা পাচ্ছি না। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ ঢেমশা এলাকার একজন নিখোঁজ রয়েছেন।’
বৃহস্পতিবার সকালে লোহাগাড়ার আমিরাবাদ ও পদুয়া এলাকা থেকে দুই মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তারা হলেন কলেজছাত্র সাকিব ও অটোরিকশা চালক আব্দুল মাবুদ। এদিন সাতকানিয়ায় পাওয়া যায় আরও ৪ মরদেহ। তারা হলেন- সাতকানিয়া পৈরসভার সাকিব, ইদ্রিস, বদিউল আলম ও আব্দুর রহীম।েএছাড়া পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের নুরুল আলমের ১০ বছর বয়সি মেয়ে তাহিদা বেগম ও সাত বছর বয়সি ছেলে আমির হোছাইন এবং একই এলাকার ছাবের আহমদের আট বছর বয়সি মেয়ে হুমাইরা বেগমের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
পেকুয়ার উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তোফাজ্জল করিম বলেন, বুধবার বিকালে তিন শিশু পাশের সাহেবখালী খালের পাশে ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে যায়। সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফেরার পথে সাহেবখালী খালে পড়ে নিখোঁজ হয়। বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে ওই খালে তাদের মরদেহ ভেসে ওঠে। তিন শিশুর লাশ উদ্ধার করে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
Discussion about this post