চট্টগ্রাম, ২১ অক্টোবর, ২০২২:
বিগত কয়েক মাস ধরে ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানামুখি সমস্যায় জর্জরিত হয়ে সীতাকু-ে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো বন্ধের উপক্রম দেখা দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ঙ্গ মাস ডলারের এই দাম বৃদ্ধি থাকলে অনেক শিপ ব্রেকার্স তাদের ব্যবসা গুটিয়ে পেলা ছাড়া কোন পথ থাকবে না। সরকার যত শীঘ্রই সম্ভব ডলারের দাম কমিয়ে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসবে ততই ব্যবসায়ীদের মঙ্গল।
তার উপর সম্প্রতি ইয়ার্ডে কোন রকম অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটলে মন্ত্রণালয় কোন রকম তদন্ত ও অভিযোগ ছাড়াই ইয়ার্ডের যাবতীয় কার্যক্রমসহ জাহাজ আমদানি বন্ধ করে দিচ্ছে। বেশি দামে বিদেশ থেকে স্ক্র্যাপ জাহাজ ক্রয় করে দেশে কাটিংয়ের মাধ্যমে কম দামে বিক্রি করে শিপ বেকিং ইয়ার্ড মালিকরা লোকসানের পর লোকসানে দিশেহারা। সরকারকে সবোর্চ্চ রাজস্ব দেওয়া এ খাত সীতাকু-ের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড বন্ধের উপক্রম এবং এতে বেকার হবে হাজার হাজার শ্রমিক।
চট্টগ্রামের সীতাকু- উপজেলার সমুদ্র উপকূলে প্রায় ১৫ কি.মি. জুড়ে গড়ে উঠেছে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। ১৯৮০ সালে ফৌজদারহাট সাগর উপকূল এলাকায় ৪টি ইয়ার্ড থেকে যাত্রা শুরু হয় এই শিল্পের। বর্তমানে ভাটিয়ারী, মাদাম বিবির হাট, সোনাইছড়ি, জোড় আমতল কুমিরা ও দক্ষিণ বাশঁবাড়িয়া পর্যন্ত প্রায় ১৭০টি ইয়ার্ড গড়ে উঠলেও পরিস্থিতির কারণে বাঁশবাড়িয়া ইয়ার্ডগুলো এখনো চালু হয়নি। তবে অন্য এলাকার ইয়ার্ডগুলো কমবেশি চালু রয়েছে। ১৭০টি শিপ বেকিং ইয়ার্ডের মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫টি শিপ ইয়ার্ড চালু থাকলেও স্ক্র্যাপের দাম কমে যাওয়ায় পুরাতন শিপের ক্রয় মূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেক শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকরা স্ক্র্যাপ বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। এসব শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে সারা দেশ থেকে এসে তিন লক্ষ শ্রমিক কাজ করছে। সরকার প্রতি বছর শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে প্রায় ১২ শত কোটি টাকা বেশি রাজ্বস্ব পেয়ে থাকে। বিদেশ থেকে আমদানি করা স্ক্র্যাপ জাহাজের মালামালগুলো সারাদেশে এমনকি বিদেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে।
জানা যায়, গত এপিল মাসে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের বাজার দর ছিল স্ক্র্যাপ প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা, প্লেট বার ৭০ থেকে ৭৫ টাকা পর্যন্ত, দোকানদারি মালামাল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা। ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক মাস ধরে হঠাৎ এসব মাল কেজি প্রতি ১০ টাকারও বেশি কমে গেছে। এভাবে শিপ ব্রেকিং মালিকেরা হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে থাকলে বাকি শিপ ইয়ার্ডগুলো বন্ধ হতে পারে বলে ধারণা করছে ব্যবসায়ীরা এবং বেকার হতে পারে হাজার হাজার শ্রমিক। সারাদেশে রি-রোলিং মিলগুলোতে রডের কাঁচামাল হিসেবে স্ক্র্যাপ ও প্লেট ব্যবহার করা হয়। যার ৮০ ভাগই সীতাকু-ের এসব শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে যোগান দেওয়া হয়। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কোন অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা ঘটলে মন্ত্রণালয় কোন রকম তদন্ত ও অভিযোগ ছাড়াই ইয়ার্ড বন্ধসহ জাহাজ আমদানি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ঐ অবস্থায় ব্যাংক থেকে নেওয়া কোটি কোটি টাকার সুদের হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। ব্যাংকের কিস্তি ও সুদ পরিশোধে অনেক ইয়ার্ড মালিক দেউলিয়া হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছেন। জাহাজ আমদানিকারক ইয়ার্ড মালিকগণ পুরাতন সামগ্রীর ক্ষেত্রে একবার উৎসের আরেকবার পণ্যের ভিত্তিতে শুল্ক পরিশোধ করে থাকে। অর্থাৎ একই পণ্যের জন্য দুইবার শুল্ক পরিশোধ করতে হচ্ছে। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি শতভাগ অগ্রিম পরিশোধ করা হয়। যা অন্য কোন শিল্পে নেই। এর পরও সরকারের রাজস্ব বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কার্যক্রমে ইয়ার্ড মালিকগণ পদে পদে হয়রানি হচ্ছে। সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ২০২৩ সালের মধ্যে সকল শিপ ইয়ার্ডকে গ্রিন শিপ ইয়ার্ড উন্নীত করার লক্ষে শিপ রিসাইক্লিং ফেসিলিটি প্লান বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আর এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে মালিকগণ ব্যাংক ঋণের সহায়তায় বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছেন। সরকার যদি এই শিল্প জোন এলাকায় স্মার্টসিটিসহ অন্য কোন কর্মযজ্ঞ গড়ে তুলে শিপ মালিকরা এসব পুঁজি হারিয়ে পথে বসবেন।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অস্বাভাবিক ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রতি কেজি স্ক্র্যাপ লোহা ১০ থেকে ১৫ টাকা দাম কমে গেছে। ক্রয় মূল্য বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন, কিন্তু বিক্রয় মূল্য কমছে প্রতিনিয়ত। যার দরুন বেশির ভাগ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে স্ক্র্যাপ লোহাসহ মালামাল বিক্রি বন্ধ রেখেছে। প্রাণচাঞ্চল্য নেই শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড এলাকায়, এখন দিনের বেলায়ও অনেকটা সুনসান নিরবতা দেখা যাচ্ছে।
পুরাতন স্ক্র্যাপ জাহাজের সেফ, তামা, পিতল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স আনান এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারি মোহাম্মদ হোসেন বলেন, দেশে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইয়ার্ড মালিকগণ প্রচুর ক্ষতির মধ্যে পড়েছে। ইতিমধ্যে ক্রয়-বিক্রয়ে না মিলায় অনেক ইয়ার্ড মালিক স্ক্র্যাপসহ বিভিন্ন মালামাল বিক্রি বন্ধ রেখেছেন। আমরাও চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন পণ্য সঠিক সময়ে রপ্তানি করতে না পারলে বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নিবে।
নানা সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি ও আরেফিন এন্টারপ্রাইজ শিপ ইয়ার্ডের মালিক মোঃ কামাল উদ্দিন বলেন, গত কয়েকমাস ধরে আমার ইয়ার্ডে পুরাতন স্ক্র্যাপ জাহাজের মালামাল বিক্রিতে কোন তাল পাচ্ছি না। কয়েক মাস আগেও যেই স্ক্র্যাপ মাল বিক্রি করেছি ৬৫/৭০ টাকা, এখন সেই স্ক্র্যাপ মালের দাম হয়ে গেছে ৫০/৫৫ টাকা। সরকারের রাজস্বের বড় একটি অংশ এই শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে আসে। যথচ অনাকাজ্ঞিত দুর্ঘটনা ঘটলে কোন রকম তদন্ত ও অভিযোগ ছাড়াই ইয়ার্ডের কার্যক্রম বন্ধসহ জাহাজ আমদানি বন্ধ করে রাখে। আর এই ফাঁকে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণে সুদের হার বেড়ে ইয়ার্ড মালিক দেউলিয়া হওয়ার পথে বসছে। আমরাই দেশের একমাত্র শিল্প যেখানে শতভাগ শুল্ক দিয়ে জাহাজ আমদানি করি। শিপ ব্রেকার্স এসোসিয়েশনের নেতা হওয়ায় দিন শেষে আমাদের ইয়ার্ড মালিকদের অনেক অভিযোগ শুনতে হয়। তারপরও কত রকম সরকারি দপ্তরের হয়রানিতে আমরা দিশেহারা।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ আবু তাহের বলেন, ২০ হাজার টনের একটি জাহাজ ক্রয় করে বর্তমানে বিক্রি করলে প্রায় ১০/১২ কোটি টাকা লোকসান হবে। দেশে ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় জাহাজের এলসি মূল্যের সাথে দেশি বিক্রি মূল্যের অনেক তফাৎ। আর এভাবে চলতে থাকলে জাহাজ আমদানি কমে যাবে, দেশে জাহাজের বিভিন্ন জিনিসের সংকট দেখা দিবে। জাহাজ মালিকগণ লোকসান দিতে দিতে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলবে। সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাবে। ছবি: সংগ্রহ
Discussion about this post