চট্টগ্রাম, ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৩:
ব্যুৎপত্তির দিক থেকে, ‘নির্বাণ’ মানে ‘নিভে যাওয়া’ কিংবা ‘শীতল হওয়া’। অনেকে নির্বাণের ‘নিভে যাওয়া’ অর্থ গ্রহণ ক’রে বলেন, ‘নির্বাণ’ মানে ‘সত্তার অবলুপ্তি’। এরা বলেন, বাসনাই জীবন। জীবন দুঃখস্বরূপ। বাসনার নাশে দুঃখ নাশ হয়। ফলে, জীবনেরও নাশ হয়। এভাবে নির্বাণকে পূর্ণ বিনষ্টি অর্থে গ্রহণ করা হয়।’ ‘অন্য অনেকে বলেন, ‘নির্বাণ’ নানে ‘শীতল হওয়া’। নির্বাণ পূর্ণবিনষ্টি হ’তে পাবেনা। যে কামনা- বাসনা মানুষকে উত্তেজিত ক’রে দুঃখের দিকে নিয়ে যায়, তাদেব পূর্ণনাশই নির্বাণ। ‘দীঘনিকায়ে’ বলা হয়েছে, কামনা-বাসনার পূর্ণ- বিনষ্টিই নির্বাণ। মনে হয়, ‘নিতে যাওয়া’ ও ‘শীতল হওয়া’, দুটি অর্থেই ‘নির্বাণ’ শব্দটিকে গ্রহণ করা উচিৎ। দুটি অর্থ নির্বাণের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকের নির্দেশ ক’রে। নির্বাণের স্বরূপ নিয়ে বিভিন্ন বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতভেদ রয়েছে। কিন্তু, তারা সকলেই এবিষযে একমত যে, সত্তার চূড়ান্ত অবস্থাই নির্বাণ এবং বাক্য ও বুদ্ধি তাকে প্রকাশ করতে পারেনা। ‘অ-জাত’, ‘অ-ভুত’, ‘অ-সৃষ্ট’ প্রভৃতি নিষেধাত্মক শব্দের সাহায্যে নির্বাণেব কথা বলা হয়েছে। নানা বৌদ্ধগ্রন্থে নির্বাণ সম্পর্কে একই কথা বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। ‘নির্বাণ’ এমন একটি অবস্থা, যেখানে পৃথিবী, জল, দিকচিহ্নহীন দেশ, সীমাহীন চৈতন্য প্রভৃতি কিছুই নাই। ‘আসা’, ‘যাওয়া’, ‘স্তির’, ‘উৎপত্তি’, ‘বিনাশ’ প্রভৃতি কোনও শব্দই নির্বাণে প্রযোজ্য নয়। নির্বাণ স্বরূপতঃ অনির্বচনীয় হ’তে পাবে। কিন্তু, নির্বাণের নিছক নেতিবাচক বর্ণনায় অসুবিধা ঘটে। নির্বাণ অভাবাত্মক অবস্থা বা শুন্যতামাত্র হ’লে কোনও মানুষই বুদ্ধ- প্রবর্তিত কঠোর নীতিমার্গে বিচরণের দ্বারা তাকে লাভ করতে উৎসাহী হ’তে পারেনা। ভাবাত্মক লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য মানুষ যে কোনও কঠোর নীতি অবলম্বন করতে পারে। ফলে, চরমলক্ষ্য হিসাবে ‘নির্বাণ’ নিরর্থক হয়ে পড়ে। এককথায়, নির্বাণের নিঘেধমুখে বর্ণনা, বুদ্ধবাণীর তাৎপর্যকে পরাস্ত করে। একারণে, অনেকে নির্বাণ সম্পর্কে ইতিবাচক ব্যাখ্যা দেন। এদের মতে, নির্বাণ পরমসত্তাস্বরূপ। এই পরমসত্তা সকল দুঃখ ও পরিণামের অতীত, অবিকৃত, স্থির, শান্ত, অবিনাশী, নিষ্কলুষ, শান্তি ও আনন্দময়। নির্বাণ একটি দ্বীপ, আশ্রয়, পরম লক্ষ্যস্থল। তথাগতেব অতিমৃত্যুর অবস্থাই নির্বাণ। নির্বাণ বিনাশের নামান্তর নয়। কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে বুদ্ধ কোনও মতামত দেননি। ‘নির্বাণ’ সেই বিষয়সমূহেব অন্যতম। বুদ্ধ যেন নির্বাণকে অনির্বচনীয় অবস্থা বলতে চেয়েছেন। তবে, অনির্বচনীয় ও অভাবাত্মক অভিন্ন নয়। কোনও কোনও দার্শনিক মনে করেন, উপনিষদীয় মোক্ষ থেকে বুদ্ধকথিত নির্বাণ ভিন্ন নয়। নির্বাণলাভের অর্থ শাশ্বতসত্তা লাভ। যারা নির্বাণকে ভাবাত্মক অবস্থা বলেন, তাদের কারও কারও মতে, নির্বাণের স্বরূপ বাক্য, মন ও বুদ্ধির অতীত। বুদ্ধ-অভিমত ‘নির্বাণ’ কি, সে সম্পর্কে সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। এ ব্যাপারে মোটামুটি সিদ্ধান্তে আসতে গেলে পূর্বে বিভিন্ন বৌদ্ধ দার্শনিক, স্ব স্ব দৃষ্টিভংগী অনুসারে, নির্বাণ সম্পর্কে যা বলেছেন, সেগুলি আলোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। এসব আলোচনার মধ্য দিয়ে, নির্বাণ সম্পর্কে একটা ইংগিত পাওয়া যেতে পারে। তবে, বিভিন্ন মত আলোচনাকালে, মনে রাখা দরকার, বৌদ্ধদার্শনিকদের মধ্যে কেউই নির্বাণকে অভাবাত্মক অবস্থা মনে করেননি। এরা প্রত্যেকেই নির্বাণকে ভাবাত্মক অবস্থা বলেন। তাহ’লে তাদের মধ্যে মতভেদ কেন? বিভিন্ন বৌদ্ধ দার্শনিক স্বতন্ত্র দর্শনসমূহেব স্থাপয়িতা। বুদ্ধ নানাসময়ে, বিভিন্ন অবস্থায়, অনেক বিষয়ের মত, নির্বাণ সম্পর্কেও বিভিন্নপ্রকার, এমনকি আপাত-বিপরীত কথাও বলেছেন। বৌদ্ধ দার্শনিকগণ স্ব স্ব দৃষ্টিভংগী অনুসারে নির্বাণের নানা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এইসব বিভিন্ন, এমনকি বিপরীত বক্তব্যের মধ্য থেকে, বুদ্ধ নির্বাণ সম্পর্কে নিজে কী বলতে চেয়েছেন, তা নির্ণয় করা দুষ্কর। তবে, সিদ্ধান্তে আসতে গেলে, একটি কথা বিশেষভাবে মনে বাখা দরকার। যে কোনও বিষযের মত, নির্বাণ সম্পর্কে বুদ্ধের নানা বক্তব্য যে বিপরীত মনে হয়, তার কারণ আমাদের অবিদ্যা- প্রসূত ব্যবহারিক-বুদ্ধি। সংস্কারভেদই বুদ্ধিভেদের কারণ। বুদ্ধিভেদের ফলে, নানা মানুষের ব্যবহারিক-বুদ্ধিও ভিন্ন। অবিদ্যা সংস্কাবের হেতু। বিভিন্ন বৌদ্ধ দার্শনিক তাদের স্ব স্ব ব্যবহারিক বুদ্ধির আলোকেই পৃথক পৃথক দর্শন গড়ে তুলেছেন এবং তদনুসারে নির্বাণ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তের অবতারণা করেছেন। দর্শন, বিজ্ঞান, প্রভৃতি সবই ব্যবহারিক- বুদ্ধি প্রসূত। সুতরাং, বিভিন্ন দার্শনিকমত আলোচনা করতে করতেই, নির্বাণ সম্পর্কে একটি ধারণা গড়ে তুলতে চেষ্টা করতে হবে।
প্রাচীন বৈভাষিক (স্ববিরবাদী) বলেন, আত্মা স্বরূপতঃ অচেতন দ্রব্যমাত্র। দেহের সংগে সংশ্লিষ্ট হবার সংগে সংগে, এই অচেতন দ্রব্যস্বরূপ আত্মা কয়েকটি মানসিক অবস্থা উৎপাদন করে। পুনরায়, দেহের সংগে অসংশ্লিষ্ট হ’লে, আত্মা মানসিক অবস্থার উৎপাদন থেকে বিরত হয়। আত্মার দেহ-অসংশ্লিষ্ট অবস্থাই নির্বাণ। নির্বাণ-প্রাপ্ত অচেতন দ্রব্যরূপ আত্মাতে সুখ কিংবা দুঃখাবস্থা থাকেনা। নির্বাণ সুখকর কিংব। আনন্দময় অবস্থা নয়।
নব্যবৈভাষিক এবং সৌত্রান্তিকমতে, আত্মা দ্রব্য নয়। সৎকার্যদৃষ্টি (Substance-view) এবং তার সহকারী কামনা-বাসনা-জন্য সংস্কারবশে প্রবহমান, একে অন্যের সংগে অসংযুক্ত ধর্মসমূহের (elements) সমাহারই ব্যবহারিক-সৎ বস্তু। এভাবে, অনুরূপ ধর্মসমূহের সমাহারই আত্মা। সৎকায়দৃষ্টি ‘ও সহকারী কামনা-বাসনার জন্য সংস্কারের প্রভাবে ধর্মসমূহ উপাদানস্কন্ধ উৎপাদন করে। হেতুসাপেক্ষ সত্তাই-উপাদান স্কন্ধ। উপাদান স্কন্ধমাত্রই দুঃখের উৎপাদক। ধর্ম (virtue) পালন ও চিত্তের একাগ্রতা সাধন সমন্বিত প্রজ্ঞার ব্যাপার দ্বারা ধর্মসমূহ (elements) একে অন্য থেকে বিশ্লিষ্ট হয় এবং তাদের পরস্পর-অসংশ্লিষ্ট অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে। [প্রতিসংখ্যা- নিবোধো যো বিসংযোগঃ পৃথক্’-অভিধর্মকোঘব্যাখ্যা।] বিকারেব উৎপাদক সংস্কারসমূহ নিরুদ্ধ হওয়ায় ধর্মসমূহ তাদের অনাশ্রব (undefiled) অবস্থায় বিদ্যমান থাকে। বৈভাষিক কিংবা অন্য যে কোনও বৌদ্ধ- দার্শনিকমতে, নির্বাণ কখনও শূন্যতার নামান্তর নয়। বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিকগণ মনে করেন, ‘অসংস্কৃত ধর্ম-অবস্থাই নির্বাণ। দৃশ্যমান, ব্যবহারিক সংসাবের অন্তরালে বর্তমান যে হেতু-নিরপেক্ষ পরমার্থসত্তা, তাই-ই ‘অসংস্কৃত ধর্ম’। একথা সত্য যে, নির্বাণে সংসার-প্রবাহের রূপ ও উজ্জ্বলতা থাকেনা। তবুও, এই নির্বাণ রূপ অসংস্কৃতধর্ম পরমার্থ-সৎবস্তুই। তথাগতের মৃত্যুর অতীত অবস্থাই নির্বাণ। তাই, কোনও বৌদ্ধই নির্বাণের সত্তা অস্বীকার করেননি। তারা ওধুমাত্র বলেন, নির্বাণ অব্যক্ত। নির্বাণ অসংস্কৃত। তাই, সংস্কৃত সাংসারিক বস্তুর মত, ভাবাত্মক নয়, কিংবা উৎপত্তি-স্থিতি-বিনাশের অধীন নয়। নির্বাণ বস্তুমাত্রের পূর্ণ বিনাশও নয়। তাই তা অভাবাত্মক নয়। বৈভাষিকগণ স্বার্থহীন ভাষার বলেছেন, নির্বাণ অভাবাত্মক অবস্থা নয়। সংস্কারসমূহের অভাববিশিষ্ট একটি ধর্মই নির্বাণ। নির্বাণ একটি ভাবাত্মক অবস্থাই। তবে, এই ভাবাত্মকতা সাংসারিক বস্তুর ভাবাত্মকতা থেকে ভিন্ন। বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিকগণ বলেন, সকল সাংসারিক ভাবাত্মকতা ‘ও চিত্তবৃত্তির নিরোধই নির্বাণ। স্কন্ধ বা সংঘাতমাত্রের বিনাশই নির্বাণ। বন্ধনকালে, মানসিক অবস্থার একটা প্রবাহ চলতে থাকে। নির্বাণ অভাবাত্মক অবস্থা নয়। নির্বাণ ঘটলে, সংস্কৃত ধর্মসমূহ অন্য একটি অসংস্কৃত ধর্মাবস্থায় (State of inoperative existence) পরিণত হয়। নির্বাণ দ্বিবিধ: সাময়িক ও শাশ্বত। সাময়িক নির্বাণকে ‘অপ্রতিসংখ্যানিরোধও’ বলে। সত্যের সম্যক জ্ঞানের সাহায্যে শাশ্বত নির্বাণ লাভ করা যায়। শাশ্বত-নির্বাণেব অন্য নাম ‘প্রতিসংখ্যানিরোধ’। বুদ্ধনির্দেশিত মার্গে বিচরণ করলে সত্যের, সম্যক জ্ঞান হ’তে পারে।
বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ বলেন, চিত্তের শুদ্ধতাপ্রাপ্তিই নির্বাণ। ‘চিত্ত’, ‘বিজ্ঞান’, ‘চৈতন্য’, ‘মন’, ‘আত্মা’ প্রভৃতি প্রতিশব্দ। ‘সর্বদর্শন সংগ্রহে’ বিজ্ঞান-বাদী কথিত নির্বাণের কথা বলতে গিয়ে মাধবাচার্য্য বলেন, যখন আমরা নিয়ত-ধ্যানের মধ্য দিয়ে, সকল পূর্বতন সংস্কার ও ধারণা থেকে নিজেদের চিত্তকে মুক্ত করতে পারি, তখন ভ্রান্তবস্তুর আকাররহিত জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এই অবস্থাকে ‘নহোদয়’ বলে। শুদ্ধজ্ঞান বা চৈতন্যস্বরূপতাই নির্বাণ। নির্বাণে জ্ঞান বিশুদ্ধ হ’য়ে, তার স্বরূপ লাভ করে। ‘নির্বাণের’ অর্থ সর্ববস্তুর নিষেধ নয়। কোনও বিষয়কে অবলম্বন ক’রে, যে বিষয়- বিষয়ীভাব উৎপন্ন হয়, তার নিষেধই নির্বাণ। নির্বাণ চরম, অন্য- নিরপেক্ষ, আত্মসাপেক্ষ (self-determined), স্বনিয়মে বিকশিত অবস্থা- বিশেষ। বিষয়সৃজনক্ষম প্রদীপের মত স্বপ্রকাশ, স্বসংবিত্তির অবস্থাই নির্বাণ। নির্বাণ রূপ শুদ্ধজ্ঞান, নিজের অন্তরে নিহিত শক্তিতেই নানা আকার (বিষয়) উৎপাদন করে। নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তি লোকাত্তর ও সকল দ্বৈতভাবরহিত (Non-dual) জ্ঞান স্বরূপ। এই জ্ঞান, বিষয় ও বিষয়ীর দ্বৈতভাব এবং ব্যবহারিক জ্ঞানে প্রকাশিত সকল বিষয়ীতা ও বিষয়তার অসারতা প্রতিপাদন করে। বিজ্ঞানবাদী মতে, নির্বাণ চতুর্বিধঃ (১) এই নির্বাণ ‘ধর্মকায়ের’ অন্য নাম। সকল বিষয়ের অন্তনিহিত শুদ্ধ অবস্থাই ‘ধর্মকায়’। যে কোনও চেতন জীব, নিজের স্বাভাবিক শুদ্ধ ‘ও নিষ্কলুষ সত্তাবলে ‘ধর্মকায়’ নামক নির্বাণলাভ করতে পারে। (২) উপাধিশেষ নির্বাণ: এই নির্বাণে কামনা-বাসনার পূর্ণ নিরোধ ঘটলেই, দেহ ও মন নামক উপাধি, কামনা-বাসনা শূন্যভাবে, অবশিষ্ট থাকে। এই নির্বাণে সত্তা সকল গুণ বা বৃত্তি থেকে মুক্ত থাকে। তবুও, এখানে জড়ত্বের বন্ধন থেকে যায়। অদ্বৈত বেদান্ত ও সাংখ্যদর্শনে কথিত জীবমুক্তি ‘উপাধিশেষ নির্বাণের’ সদৃশ। নির্বাণ লাভের পর, সংসারে প্রত্যাবৃত্ত বুদ্ধ, উপাধিশেষ নির্বাণের দৃষ্টান্ত। (৩) অনুপাধিশেষ নির্বাণ: এর অন্য নাম পরিনির্বাণ। এই নির্বাণে কোন উপাধির অবশেষ থাকে না। সর্ববিধ জড়ত্বের বন্ধন থেকে পূর্ণমুক্তিই অনুপাধিশেষ নির্বাণ। (৪) কেউ কেউ ‘অপ্রতিষ্ঠিত নির্বাণ’ মানেন। এ অবস্থায় নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তি, চূডান্তমুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, স্ব ইচ্ছাতেই সর্বভূতের হিতসাধনের জন্য, সংসারে থাকেন। এটি শুদ্ধ ও চরম প্রজ্ঞার অবস্থা।
মাধ্যমিকগণ বৈভাষিক ও বিজ্ঞানবাদীর নির্বাণতত্ত্বের কঠোর সমালোচনা ক’রে, স্বমত স্থাপন করেছেন। বৈভাষিকমতে, নির্বাণ যে অর্থে ভাবাত্মক, তা মাধ্যমিক দার্শনিক নাগার্জুনের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বৈভাষিক বলেন, নির্বাণ ভাবাত্মক ও অসংস্কৃত (অনুপাদান) অবস্থা। নাগার্জুন মনে করেন, নির্বাণ একই সংগে ভাব ও অসংস্কৃত অবস্থা হ’তে পারে না। [ভাবশ্চ চ যদি নির্বাণম্ নির্বাণম্ সংস্কৃতম্ ভবেৎ, নাসংস্কৃতো হি থিদ্যতে ভাবঃ ক্কচন কশ্চন ভাবশ্চ যদি নির্বাণম্ অনুপাদায় তৎকথম্। মাধ্যমিককারিকা।] একই যুক্তিতে মাধ্যমিক বলেন, বস্তুর প্রবাহের কোনও একটি বিশেষ স্তবে ক্লেশ ও কর্মের বিনাশের কথা স্বীকার করা যায় না। বস্তুপ্রবাহের কোনও বিশেষ স্তরে ক্লেশ ও কর্মের নিরোধ সম্ভব হ’লে, এবং এই নিরোধই নির্বাণ হ’লে, নির্বাণের হেতুসাপেক্ষতা প্রমাণিত হয়। ফলে, নির্বাণ আকস্মিক ও অনিত্য হ’য়ে পড়ে। যাঁরা বলেন নির্বাণে সকল সত্তা, সংস্কৃতধর্মের অবস্থা থেকে অসংস্কৃত ধর্মের অবস্থায় পরিণত হয়, তাদের সমালোচনায় মাধ্যমিক বলেন, বস্তুর পরিণাম হ’তে পারে না। যা সৎ, তার নিষেধ অসম্ভব। ক্লেশ ও কর্ম সৎ হ’লে, কখনও তার নিরোধ ঘঁটতে পারে না ।
বিজ্ঞানবাদীর নির্বাণতত্বের সমালোচনায় মাধ্যমিক বলেন, বিজ্ঞানবাদী যে সর্ববিষয়ের সংগে সম্পর্কবহিত শুদ্ধজ্ঞান রূপ নির্বাণের কথা বলেন, তা কল্পনাপ্রসূত, মিথ্যা, অবাস্তব। বিজ্ঞানবাদীমতে ‘আত্মা’ ‘বিজ্ঞান’ ‘মন’ ‘চিত্ত’ প্রভৃতি প্রতিশব্দ। মাধ্যমিক বলেন, বিষয়জ্ঞানকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞান- বাদী কথিত আত্মসংবেদন (self-knowledge) সম্ভব নয়। শুদ্ধ নির্বিষয জ্ঞান (চৈতন্য) শূন্যগর্ভ ব’লে অলীক। মাধ্যমিকগণ সংসার (ব্যবহারিক জগৎ ও জীবন) সম্পর্কে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করতে চান। মাধ্যমিকমতে, বিষয়ী (চৈতন্য বা জ্ঞান) এবং বিষয়, স্বরূপতঃই একে অন্যের সাপেক্ষ। যা সাপেক্ষ-সৎ, তা পরমার্থসৎ বলে বিবেচিত হ’তে পারেন।। শুধুমাত্র অন্যনিরপেক্ষসৎ-ই পরমার্থসৎ। ‘নির্বাণ’ রূপ পারমার্থিক দৃষ্টির আলোকে বিজ্ঞানধাদী কথিত ‘শুদ্ধজ্ঞান’ মিথ্যা, অসৎ। বিষয় ও বিষয়ী, চৈতন্য এবং তার বিষয়,-সবই প্রতীত্যসমুৎপন্ন, পরস্পরসাপেক্ষ। তাই তারা স্বভাবরহিত। স্বভাবরহিতত্ত্বই শূন্যতা। যা অন্যনিরপেক্ষসৎ, তাই স্বভাব- বিশিষ্ট। বিষয় ও বিষয়ী, সবই কল্পনা বা ভাবনার সৃষ্টি।
নির্বাণ সম্পর্কে, মাধ্যমিকগণ দুটি ব্যাপারে, বৈভাষিকদের সঙ্গে একমত নন। বৈভাষিকমতে, নির্বাণে সংস্কৃত (discrete) ধর্মসমূহ অসংস্কৃত (inoperative) ধর্মসমূহে বস্তুতঃই পরিণত হয়। এর বিরুদ্ধে মাধ্যমিকগণ বলেন, ধর্ম বা বস্তুর কোনও পরিণাম বস্তুতঃ ঘটতে পারে না। ক্লেশ সমূহ সৎ বস্তু হ’লে, বিনষ্ট হ’তে পারে না। বস্তুর পরিণাম অসম্ভব। শুধুমাত্র আমাদের দৃষ্টিভংগীরই পরিণাম ঘটতে পারে। মাধ্যমিক পরিভাষায় ‘যার প্রহাণ, অর্জন, উচ্ছেদ, নিত্যতা, নিরোধ, উৎপত্তি হয় না, তাই নির্বাণ’। [স্বভাবেন হি ব্যবস্থিতানাম্ ক্লেশানাম্ স্কন্ধানাম্ চ স্বভাব- স্যানপারিত্বাৎ কুতে। নিম্নত্তি: যতস্তন্নিবৃত্ত্যা নির্বাণম্….. যদি খলু শন্যবাদিন: ক্লেশানাম্ স্কন্ধানাম্ ব। নিবৃত্তিলক্ষণম্ নির্বাণম্ নেচ্ছন্তি কিং লক্ষণম্ তহিচ্ছন্তি। উচ্যতে; অপ্রহীণাম্ অসম্প্রাপ্তম্ অনুচ্ছিন্নম্ অশাশ্বতম্ অনিরুদ্ধম্ অনুৎপন্নম্ এতন্ নির্বাণম্ উচ্যতে’। মাধ্যমিক- কারিকাব্বত্তি। প্রঞ্জাই নির্বাণের পথ। মাধ্যমিকগণ বলেন, যা সৎ, তার পরিণাম ঘটানো প্রজ্ঞার কাজ নয়। প্রজ্ঞা, সত্তা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভংগীরই পরিবর্তন ঘটায়। পরিণাম মাত্রই জ্ঞানীয় (subjective), বস্তুগত (ontological) নয়। যা সৎ, তা চিরকাল একইভাবে সৎ।
মাধ্যমিকগণ বলেন, ‘ভাব’ কিংবা ‘অভাবের’ কোনটিই নির্বাণ সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়। সকল বিশেষণের পরামর্শের ক্ষয়ই নির্বাণ। [ভাবাভাব- পরামর্শ করনির্বাণম্।] সকল ভাববৃষ্টি ও অভাবদৃষ্টি বর্জন করলেই নির্বাণ লাভ করা যায়। মাধ্যমিক বলেন, প্রজ্ঞা বস্তুর রূপান্তর ঘটায় না, দৃষ্টি- ভংগীতেই পবিবর্তন আনে। নির্বাণ ও সংসার স্বরূপতঃ ভিন্ন নয়। পারমার্থিক ও সাংব্বতিক, সম্পূর্ণ ভিন্ন নয়, একই সত্তার দুটি অবস্থাও নয়। দুটি ভিন্ন দৃষ্টকোণ থেকে একই সত্তাকে পারমার্থিক ও সাংস্কৃতিক বলা হয়। পরমার্থসৎ-ই একমাত্র সৎ। কল্পনাপ্রসূত সাংবৃতিক সত্তার (সংসার) অন্তর্নিহিত সত্তাই পারমার্থিকসত্তা। সৃষ্টিক্ষম-কল্পনার ধারণা- সমূহের মাধ্যমে প্রতীত পরমার্থসত্তাই ‘সংসার’। বিকাবসৃষ্টিকারী এই ধারণাসমূহ বর্জন ক’রে, পবর্মার্থসত্তাকে যথার্থ স্বরূপে অনুভবই ‘নির্বাণ।
মাধ্যমিকগণ মনে করেন, তাদের নির্বাণতত্বই বুদ্ধের বাণী-অনুসারী। বুদ্ধ ভাবদৃষ্টি ও অভাবদৃষ্টি বর্জন করতে বলেছেন। তথাগত, মৃত্যুর পর থাকুন, না-থাকুন, উভয়ই হোন্ কিংবা কোনটাই না-হোন্-তার স্বরূপ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি ‘অব্যাকৃত’ (Inexpressible)। মাধ্যমিকগণ বলেন, তাদের নির্বাণতত্ত্বই তথাগতের অব্যাকৃতস্বরূপের প্রকৃত নির্দেশক।
মাধ্যমিকগণ যে নির্বাণের কথা বলেছেন, তা অদ্বৈত বেদান্তের ব্রহ্ম- ভাবরূপ মুক্তি থেকে খুব বিসদৃশ নয়। অবশ্য, মাধ্যমিকদর্শনে নির্বাণকে আনন্দস্বরূপ অবস্থা বলা হয়নি। অদ্বৈত বেদান্তমতে, শুধুমাত্র দুঃখবিমুক্ত পরমার্থসত্তাই নয়,-সত্তা, চৈতন্য ও আনন্দস্বরূপতাই মুক্তি। ব্রহ্মভাবই মুক্তি এবং ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দস্বরূপ। ব্যবহারিক জ্ঞানের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে, অদ্বৈতবেদান্তী দেখাতে চেয়েছেন, অন্যনিরপেক্ষসৎ ও অপরোক্ষ ব্রহ্মই পরমার্থসৎ। সচ্চিদানন্দ রূপ ব্রহ্ম পরমার্থসৎ ব’লে যে কোনও জ্ঞান সম্ভব হয়। ব্রহ্ম সর্বব্যাপক, এক ও নিত্য। আমরা যখন কোনও ব্যবহারিক বিষয়কে কেন্দ্র ক’রে সুখলাভ করি, তখন, অবিদ্যা- প্রসূত বিষয়ের মধ্য দিয়ে সর্বভূতে বর্তমান ব্রহ্মানন্দকেই সীনিত ও অশুদ্ধভাবে অনুভব করি। মাধ্যমিক এতদূর এগোননি। সংসারের (ব্যবহারিক সৎ) সংগে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত ‘নির্বাণের’ (পরমাৎ-সৎ) নির্দেশমাত্র করেই তিনি ক্ষান্ত হন। অদ্বৈতবেদান্তী আরও অগ্রসর হ’য়ে সচ্চিদানন্দরূপে ব্রহ্মের স্বরূপ নির্দ্ধারণ করেন। দার্শনিকভাবে, মাধ্যমিক- দের ‘নির্বাণ’ নির্বিশেষ। আনন্দ কিংবা কল্যাণের দ্বারা তাকে বিশেষিত করা যায়না। আধ্যাত্মিক বিচারে, নির্বাণ তথাগতের সংগে অভিন্ন। চৈতন্যময় সত্তার লোকোত্তর জীবনই নির্বাণ।
#লেখক দেবব্রত সেন ভারতের বিভিন্ন কলেজে দর্শনের অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। লেখাটি নেয়া হয়েছে তার ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থের ‘বৌদ্ধদর্শন’ অধ্যায় থেকে। ‘ভারতীয় দর্শন’ বইটি কলকাতার ব্যানার্জী পাবলিশার্স থেকে ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়। তখন তিনি চন্দননগর সরকারি কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান ছিলেন।#
Discussion about this post