চট্টগ্রাম, ১৬ জুন, ২০২২:
পদ্মার দুই তীরের মানুষ পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছে। আনন্দে উদ্বেলিত দুই তীরের মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের উৎসব সারা দেশ জুড়ে হবে। ইতিমধ্যে সাড়া পড়েছে সারা দেশের মানুষের মধ্যে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণের খবর।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পদ্মা একটি খরস্রোতা নদী। বিশ্বের সবচেয়ে খরস্রোতা নদীগুলোর অন্যতম এই পদ্মায় বাংলাদেশ যে সেতু নির্মাণ করতে পারে সেটা অনেকেরই ধারণায় ছিল না। তারপর আবার সেতুটি একটি দ্বিতল সেতু, নীচ দিয়ে ট্রেন এবং ওপর দিয়ে গাড়ি চলাচল করবে। যেটা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ এবং পৃথিবীতে এ ধরনের কাজ বোধ হয় এটাই প্রথম। এখানে যে ধরনের মেশিনারিজ ব্যবহৃত হয়েছে, সেটাও বোধ হয় আর কোথাও হয়নি।
আর এই সেতু নির্মাণে যে বাধা-বিপত্তি ছিল সেটাও তিনি জানান।
কি ছিল সেই বাধা বিপত্তি? শোনা যাক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য থেকে। এই সেতু করতে গিয়ে তার ও তার পরিবার এবং সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে সেই অভিযোগ প্রমাণের আহবান জানিয়েছিলেন।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন সেতু নির্মাণ কাজ ব্যাহত করার জন্য বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিশ্রুত ঋণ বন্ধ করার জন্য এই দুর্নীতির অভিযোগ সাজানো হয়। এই ষড়যন্ত্রে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের পরামর্শে হিলারি ক্লিনটন বিশ্ব ব্যাংককে অর্থ সহায়তা দিতে বাধা দেন। যে কারণে পিছিয়ে যায় বিশ্ব ব্যাংক সহ অন্যরা। তারপরও সেই সেতুটি নির্মাণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যে কারণে দেশের সম্মান, গৌরব ও আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে সেতুটি।
সেই সেতুটি উদ্বোধন হবে আগামী ২৫ জুন। সেটি স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
এখন সব কিছুই হচ্ছে ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরে। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু। উদ্বোধনের পরদিন ২৬ জুন খুলে দেওয়া হবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের বহু প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। তাই গত মঙ্গলবার যেন স্বপ্নের আলোয় ঝলমল করে উঠল পদ্মা সেতুর দুই পাশ। সন্ধ্যা ৬ টা ৫৫ মিনিটে সেতুর দুই পাশের ৪১৫ টি ল্যাম্পপোস্টের বৈদ্যুতিক বাতির সুইচ টিপে আলোকিত করা হয় সেতুটি। এতে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ। আলোয় ভরে সেতুর চারপাশ। আলোর ঝলকানিতে দুলতে থাকে প্রমত্তা পদ্মার জল।
উদ্বোধনের পরদিন সকাল ৬টা থেকে যান চলাচল শুরু হবে। ২৫ জুন সকাল ১০টায় মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশের পরে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সেতু পার হয়ে জাজিরা প্রান্তে গিয়ে নামফলক উন্মোচন করবেন তিনি। সেখানে কাঁঠালবাড়ী ঘাটে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসমাবেশে বক্তব্য দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
পদ্মা সেতু রাজধানী ঢাকার সাথে সংযোগ স্থাপন করবে- দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষ, তাদের অর্থনৈতিক দিনলিপি থেকে অনেককিছুকে যুক্ত করবে রাজধানী ঢাকা ও সারা দেশের মানুষের সাথে।
পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু প্রকল্প এটি। এর মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়েছে। ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটেছে।
দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ। তবে রেলপথের কাজ এখন সম্পূর্ণ হয়নি। ৬.১৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮.১০ মিটার প্রস্থের এই সেতু দেশের সবচেয়ে বড় সেতু। পদ্মা সেতু নির্মাণকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি।
শুরুতে ২০০৮-০৯ সালে প্রকল্প প্রস্তুতির সাথে যুক্ত কিছু লোকের দুর্নীতির অভিযোগ করে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে তাদের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয় এবং অন্যান্য দাতারা সেটি অনুসরণ করে। সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সাথে ঋণ চুক্তি হয়েছিল ১২০ কোটি ডলারের। এ অভিযোগে কানাডার আদালতে মামলা হলে কানাডার আদালত এই মামলাটি নাকচ করে, ভুয়া অভিযোগের কারণে। দুর্নীতির অভিযোগের মামলা কানাডার আদালত বাতিল করলেও বিদেশি ব্যাংক ও অন্যান্যরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে টাকা না দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের সাহসি প্রধানমন্ত্রী দেশের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। পদ্মা বহুমুখী সেতুর সম্পূর্ণ নকশা এইসিওএমের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরামর্শকদের নিয়ে গঠিত একটি দল তৈরি করে। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। এ প্যানেল সেতুর নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্প কর্মকর্তা, নকশা পরামর্শক ও উন্নয়ন সহযোগীদের বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান করে।
পদ্মা সেতুর ভৌত কাজকে মূলত পাঁচটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে যথা— (ক) মূল সেতু, (খ) নদী শাসন, (গ) জাজিরা সংযোগকারী সঙক, (ঘ) টোল প্লাজা ইত্যাদি। মাওয়া সংযোগকারী সড়ক, টোল প্লাজা ইত্যাদি এবং মাওয়া ও জাজিরা সার্ভিস এলাকা। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য- ৬.১৫ কিলোমিটার, ডাঙার অংশ ধরলে এর দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় প্রায় ৯ কিলোমিটার। পদ্মা সেতুর চার লেন সড়কের প্রস্থ ৭২ ফুট।
সেতুতে রেলপথ সংযুক্তির সিদ্ধান্ত হয়- ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি। পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য- ৩.১৮ কিলোমিটার। প্রকল্পে নদীশাসন দুই প্রান্তে- ১২ কিলোমিটার। সেতুর সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য- দুই প্রান্তে ১৪ কিলোমিটার।
পদ্মা সেতুর ভায়াডাক্ট পিলার- ৮১টি। পদ্মা সেতুর পাইলিং গভীরতা- ৩৮৩ ফুট। পানির স্তর থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা- ৬০ ফুট। প্রতি পিলারের জন্য পাইলিং- ৬টি। পদ্মা সেতুর মোট পাইলিং সংখ্যা- ২৬৪টি। পদ্মা সেতুর পিলার সংখ্যা- ৪২টি। পদ্মা সেতুতে রেল ছাড়াও আরও রয়েছে- গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অপটিক্যাল ফাইবার লাইন পরিবহন সুবিধা। পদ্মা সেতুর নির্মাণ সামগ্রী- কংক্রিট ও স্টিল।
২০১৭ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পদ্মা সেতুতে পিলারের ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে এই স্প্যান বসানো হয়। এভাবে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩তম পিলারে ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু। সেতুতে মোট ৪২ টি পিলার রয়েছে। প্রত্যেকের নীচে ছয়টি পাইল। স্তম্ভগুলিতে ইস্পাত স্প্যান স্থাপন করা হয়েছে। সেতুর মোট স্প্যান ৪১ টি।
আগামী এক বছর সেতুর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিডেট। এর মধ্যে কোনো সমস্যা হলে সেটিও দেখবে প্রতিষ্ঠানটি। উদ্বোধনের এক বছর পর পদ্মা সেতু সরকারকে হস্তান্তর করা হবে।
তবে রেলপথের কাজ এখন সম্পূর্ণ হয়নি।
সেতুর খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
সেতুতে রেলপথ সংযুক্তির সিদ্ধান্ত হয়- ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি।
২০১৭ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পদ্মা সেতুতে পিলারের ওপর বসানো হয় প্রথম স্প্যান। শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর ভাসমান ক্রেনের সাহায্যে এই স্প্যান বসানো হয়। এভাবে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর ১২ ও ১৩ তম পিলারে ৪১তম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পুরো পদ্মা সেতু।
Discussion about this post