চট্টগ্রাম, ২২ জুলাই, ২০২২:
ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করার ঘটনায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। গত বুধবার রাতভর আন্দোলন করেছেন শিক্ষার্থীরা। কয়েকদিনের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার ছাত্রছাত্রীদের কর্মসূচিতে অবস্থান নিয়ে সংহতি জানান কোনো কোনো শিক্ষকও। ছাত্রীকে যৌন হয়রানির বিচার এবং নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে বৃহস্পতিবার সারাদিন ক্যাম্পাস ছিল উত্তপ্ত। বিক্ষোভ ছড়িয়ে ক্যাম্পাস জুড়ে। বিক্ষোভে যোগ দেয় ছাত্রলীগ ও প্রগতিশীল ছাত্রজোট সহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। দিনভর ক্লাস বর্জন করে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে তারা ।
ছাত্রীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় বিচার করতে ব্যর্থ হলে প্রক্টরিয়াল বডির সব সদস্যদের নিয়ে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এসএম মনিরুল হাসান।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. শিরিণ আখতার অপরাধীদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে কয়েকজন অপরাধীকে আমরা শনাক্ত করেছি।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টায় ক্লাস বর্জন করে প্রথমে বিজ্ঞান অনুষদ ও পরে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেয় রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এরপর তারা শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে সমবেত হন। সকাল থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বেলা ১২ টায় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মানববন্ধন করে প্রগতিশীল ছাত্র জোট। এ সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে অবস্থান নেন কয়েকজন শিক্ষকও।
এ সময় রসায়ন বিভাগের ছাত্রী সাজিয়া আহমেদ বলেন, যে ঘটনার বিচার চার ঘণ্টার মধ্যে হওয়ার কথা ছিল, সে ব্যাপারে চার দিন পেরিয়ে গেলেও কিছু করতে পারেনি প্রশাসন। ক্যাম্পাসকে আমরা আমাদের বাড়ির মতো মনে করি। এখানে প্রশাসন আমাদের অভিভাবক। আর আমাদের অভিভাবকরাই আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছেন না। বাংলাদেশ ছাত্রফ্রন্টের চবি শাখার সদস্য শাহানাজ মুন্নি বলেন, যদি প্রশাসন আমাদের নিরাপত্তা বিধান করতে না পারে, তাহলে এখানকার গর্বের কিছু নেই।
একইদিন বিকেলে প্রশাসনিক ভবনের সামনে মানববন্ধন করে ভুক্তভোগী ছাত্রীকে প্রক্টর বরাবর অভিযোগ প্রদানে বাধা দিয়েছে মর্মে অভিযোগ করা হয়।
এদিকে ছাত্রী হেনস্তার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দীনের অনুসারী ছাত্রলীগের উপগ্রুপগুলো।
রাত আটটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট এলাকা থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয়। এরপর চবি ছাত্রলীগের সাবেক উপবিজ্ঞগান ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল হাসান দিনারের সঞ্চালনায় সমাবেশে শাখা ছাত্রলীগের নেত্রী সামিমা সিমা, ছাত্রলীগ নেতা প্রদীপ চক্রবর্তী দুর্জয় প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
তারা বলেন, ক্যাম্পাসে আমরা ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা চাই। মেয়েদের রাত দশটায় হলের ঢুকিয়ে দেয়া কোনো সমাধান হতে পারে না। নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত লাইট ও নাইট ভিশিন ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হোক। ছাত্রী হেনস্তায় জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
চার কর্ম দিবসের মধ্যে ছাত্রী হেনস্তার বিচার করতে ব্যর্থ হলে প্রক্টরিয়াল বডির সব সদস্যদের নিয়ে পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এসএম মনিরুল হাসান।
গত বুধবার রাতে উপাচার্যের বাস ভবনের প্রবেশ পথ অবরুদ্ধ করে আন্দোলনরত ছাত্রীদের দাবির মুখে এ ঘোষণা দেন তিনি। এ সময় আন্দোলনরর ছাত্রীরা মোট ৪ দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হল- ১. বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও মেডিক্যাল সেন্টারে প্রবেশের সময়সীমা তুলে নেয়া ও ক্যাম্পাসে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ২. নতুন করে যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল গঠন করতে হবে এবং সেলে বিচার নিশ্চিতে সর্বোচ্চ সময় থাকবে একমাস। এক মাসে বিচার নিশ্চিতে ব্যর্থ হলে যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল নিজে শাস্তির আওতাভুক্ত হবে। ৩. যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলে চলমান কেইসগুলো আগামী চার কার্যিদবসের মধ্যে সমাধান করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ৪. চলমান ঘটনাগুলোর বিচার আগামী ৪ কার্যদিবসের মধ্যে করতে না পারলে প্রক্টরিয়াল বডির সবাইকে পদত্যাগ করতে হবে।
লিখিত আকারে পেশকৃত এসব দাবি মেনে নেয়ার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক এসএম মনিরুল হাসান স্বাক্ষর করলে ছাত্রীরা রাত সাড়ে ১২টার পর হলে ফিরে যান।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এসএম মনিরুল হাসান বলেন, আন্দোলনরত ছাত্রীরা আমাদের কাছে লিখিত আকারে ৪ দফা দাবি জানিয়েছে। আমরা দাবিগুলো মেনে নিয়েছি। বিচার নিশ্চিতে ব্যর্থ হলে প্রক্টরিয়াল বডির সবাইকে নিয়ে আমি পদত্যাগ করব।
প্রসঙ্গত, গত রবিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হল সংলগ্ন এলাকায় ৫ দুর্বৃত্তের হাতে শারীরিক হেনস্তার শিকার হন এক ছাত্রী। ওই সময় তার সাথে থাকা তার বন্ধু বাধা দিলে তাকেসহ ওই ছাত্রীকে মারধর করা হয় এবং তাদের মোবাইল ফোনগুলোও ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এছাড়া তাদেরকে ওই জায়গা থেকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা হয় বলেও জানান ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী।
ওই ঘটনায় মঙ্গলবার ওই ছাত্রী থানায় মামলা করেন। আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছেও লিখিত অভিযোগ দেন।
তবে শেষ পর্যন্ত নড়েচড়ে বসেছেন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ভিসি। চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, ছাত্রীকে হেনস্তা করার বিষয়টি নিয়ে আমাদের অবস্থান কঠোর। অপরাধী যেই হোক তাকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হবে না। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে কয়েকজন অপরাধীকে আমরা শনাক্ত করেছি। বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার বলি। সেদিনই তাৎক্ষণিক তদন্ত কমিটি করেছি। আরও দুটো কমিটি আমাদের আছে। একটা অভিযোগ কমিটি এবং একটা নিপীড়নবিরোধী কমিটি, হাইকোর্ট যেটা বলে দিয়েছে।
Discussion about this post