চট্টগ্রাম, ৩০ অক্টোবর, ২০২২:
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি হওয়া সাকা চৌধুরীকে ‘শহীদ’ উল্লেখ করে তার ছেলে বিএনপি নেতা হুম্মাম কাদের চৌধুরীর বক্তব্যের প্রতিবাদে গতকাল শনিবার সকালে নগরীর জামালখানে ‘গুডস হিলের’ মূল প্রবেশপথ অবরুদ্ধ করে সমাবেশ করেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড। গত ১২ অক্টোবর সাকা পুত্র হুম্মাম বিএনপির পলোগ্রাউন্ডের মহা সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় তার পিতা যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায়ে ফাঁসিতে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত সালাউদ্দিন কাদেও চৌধুরীকে ‘শহীদ’ দাবি করে বক্তব্য দিয়েছিলেন।
নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নঈম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘রাজাকারের ছেলে হুম্মাম কাদের যে বক্তব্য দিয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের শহীদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, এটা ধৃষ্টতাপূর্ণ রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বক্তব্য বলে আমি মনে করি। তার বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
গতকাল কর্মসূচি পালনকারীরা গুডস হিলের প্রবেশপথে দেওয়ালে লিখেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতন কেন্দ্র-রাজাকারের বাড়ি’। এসময় তারা সেখানে প্রতীকী তালাও ঝুলিয়ে দেন। উড়িয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা। ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় রাজাকারের ঠাঁই নাই’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় মৌলবাদীর ঠাঁই নাই’ লেখা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভও করেন ঘেরাওকারীরা।
সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। সমাবেশের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সরওয়ার আলম চৌধুরী মণি। দাবির মধ্যে রয়েছে হুম্মামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের ও তাকে গ্রেপ্তার করা, যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের রাজনীতি ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা, দ-িত যুদ্ধাপরাধীদের সকল সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা, জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে সকল যুদ্ধাপরাধীর তালিকা করে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং মুক্তিযুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্যাতনের জন্য রাজাকার-আলবদর, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গড়ে তোলা সকল ‘টর্চার ক্যাম্পকে’ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা।
সমাবেশে চট্টগ্রাম মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোজাফফর আহমেদ বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের সন্তানদের রাজনীতিতে দেখতে চাই না, রাজাকারের সন্তানদের নির্বাচনে দেখতে চাই না। রাজাকারের বাড়িঘর, সম্পত্তি অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করা হোক। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে আমরা সরকারকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিচ্ছি। আগেভাগে বলে দিচ্ছি, সরকার যদি আমাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত না করে তাহলে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামব।’
সাকা চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার অন্যতম সাক্ষি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কাজী নুরুল আবসার বলেন, ‘কুলাঙ্গার সালাহউদ্দিন কাদেরের কুলাঙ্গার সন্তান বিএনপির সমাবেশে বক্তব্য রেখেছে। বিএনপি যুদ্ধাপরাধী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাজনীতি করছে। এই বিএনপিকে অবিলম্বে বিলুপ্ত করুন। আর যদি মনে করেন, আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেই দেশের সমর্থন ও দোয়া চেয়ে বিএনপিকে রাজনীতি করার সুযোগ দেবেন, তাহলে আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধারা এই সরকারের বিরুদ্ধে নামব।’
রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহছানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘কীসের গুডস হিল, আজ থেকে এটা রাজাকার হিল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা এটাকে রাজাকার বাড়ি লিখে দিয়েছে। হুম্মাম কাদের, কুলাঙ্গারের ঘরে কুলাঙ্গার জন্ম নিয়েছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক রাসেল এবং সংগঠনের জেলা সদস্য সচিব কামরুল হুদা পাবেলের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্ত, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার সৈয়দুল হক সৈয়দ, আওয়ামী লীগ নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী, মশিউর রহমান চৌধুরী, নগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহবায়ক মাহবুবুল হক সুমন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এম আর আজিম, হাবিবুর রহমান তারেক, ইয়াছিন আরাফাত ও নুরুল আজিম রনি, নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর প্রমুখ। এর আগে আগে গত ১৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব চত্বরে সমাবেশ করে হুম্মাম কাদেরকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য সাতদিনের সময় বেঁধে দিয়েছিলেন তারা। এরপর গতকাল গুডস হিল ঘেরাও করা হয়। কিন্তু যে হুম্মাম কাদেরের বক্তব্যের প্রতিবাদে গুডস হিল ঘেরাও করা হয়েছে, সেখানে হুম্মাম কাদের বা তার পরিবারের কেউ ছিলেন না। সপরিবারে তারা ঢাকাতেই রয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধে টর্চার সেল গুডস হিল:
নগরীতে যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর পরিবারের বাসভবন গুডস হিলে অবস্থিত। অভিযোগ আছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালিদের ধরে নিয়ে হত্যা-নির্যাতনের জন্য এই গুডস হিলে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘টর্চার ক্যাম্প’।
১৯৭১ সালে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা যুদ্ধাপরাধী ফজলুল কাদের (ফকা) চৌধুরীর নির্দেশে তার বাড়ি গুডস হিলকে ‘টর্চার ক্যাম্প’ বানিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। যাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তার পুত্র সাকা চৌধুরীসহ রাজাকার-আলবদররা। বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং নিরস্ত্র বাঙালিদের ধরে এনে ওই ‘টর্চার ক্যাম্পে’ অমানুষিক নির্যাতন করা হতো বলে সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলার কয়েকজন সাক্ষির সাক্ষ্যে তা উঠে আসে।
এক সময় নেতাকর্মী ও অনুসারীদের আনাগোনায় সব সময় সরগরম থাকত গুডস হিল। এখান থেকেই চট্টগ্রামে নিজের সব কর্মকা- পরিচালনা করতেন সাকা চৌধুরী। তিনি এই পৈতৃক বাড়িতেই থাকতেন। তবে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৫ সালে তার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর থেকে অনেকটা ফাঁকা অবস্থায় আছে গুডস হিল। নেতাকর্মীদের আনাগোনা যেমন নেই, তেমনি তার পরিবারের লোকজনও গুডস হিলে তেমন আসেন না বলে জানা গেছে।
সাকা পরিবারের বাসভবনটিকেই গুডস হিল নামে চেনে সবাই। যদিও পরিবারের সবাই ঢাকাতেই বসবাস করেন। কোন কাজে তারা চট্টগ্রামে আসলে গুডস হিলে অবস্থান করেন বলে জানা গেছে।
তবে গুডস হিল দেখাশোনা করার জন্য বেশ কয়েকজন কর্মচারী নিয়োজিত আছেন। এসব কর্মচারীই সেখানে থাকেন।
গুডস হিলে কারা থাকেন সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার কোন কাজে চট্টগ্রামে আসলে তখন গুডস হিলে থাকেন। এমনিতে গুডস হিল দেখাশোনার জন্য কর্মচারী, স্টাফ আছেন। তারাই সেখানে থাকেন।
Discussion about this post