চট্টগ্রাম, ২০ অক্টোবর, ২০২২:
কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের মূল কাজ ইতিমধ্যে সমাপ্ত হয়েছে। আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে টানেল।
টানেলের মূল কাজ শেষ হওয়ায় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) ২৬ নভেম্বর জাঁকজমকপূর্ণভাবে টানেল এলাকায় পূর্তকাজের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন। টানেল টিউবের পূর্তকাজের সমাপ্ত করার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই এই অনুষ্ঠান।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির পূর্তকাজ শেষপর্যায়ে। জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো আমরা সমাপ্ত করেছি। এটি উদযাপনের জন্য একটা অনুষ্ঠান করা হচ্ছে।
তবে বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে এখন আপাতত যানবাহন চলছে না। শতভাগ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এজন্য অপেক্ষা করতে হবে। সেটা আগামী বছর প্রথম প্রান্তিকে শুরু হবে বলে সেতু কর্তৃপক্ষ জানান।
যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার আগেই নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ সমাপ্ত করতে হবে। এছাড়া উভয় প্রান্তে স্ক্যানার বসানো, সার্ভিস এরিয়া নির্মাণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ এখনো শেষ হয়নি।
এদিকে প্রকল্পটির মেয়াদ আরো একবছর বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। মূলত টানেল নির্মাণকাজ শেষ হলেও অর্থ ছাড়করণ, বাহ্যিক বিবিধ কাজ শেষ করতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো না হলেও বছরের প্রথম প্রান্তিকে উদ্বোধনের মাধ্যমে যানচলাচলের জন্য খুলে দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, টানেলের দুটি টিউবের বোরিং এবং দুই টিউবের মধ্যে ক্রস প্যাসেজ নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। সবচেয়ে জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল এগুলো। বিদ্যুৎ ও যান্ত্রিক বিভাগের কাজও শেষ পর্যায়ে। পূর্তকাজ হিসাবে এই কাজের পরিপূর্ণতা পাবে আগামী ২৬ নভেম্বর।
বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, বিশেষায়িত প্রকল্প হওয়ায় নিরাপত্তাসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করার পরই যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে। এজন্য আরো কিছু সময়ের প্রয়োজন হবে। নির্ধারিত সময় বলা যাচ্ছে না, তবে আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকে সম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করার আশা করছি।
প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুসারে, টানেলের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ শতাংশ। তবে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম টানেল টিউবের (নর্থ) ২ হাজার ৪৪৬ মিটার ও দ্বিতীয় টানেল টিউবের ২ হাজার ৪৫৮ মিটার বোরিং কাজ, প্রথম ও দ্বিতীয় টিউবের লেন স্ল্যাব, তিনটি ক্রস প্যাসেজের (সংযোগ পথ) কাজ, ভায়াডাক্ট, উভয় টিউবের পেভমেন্ট স্ল্যাব শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। পূর্ব অংশ ও পশ্চিম অংশের রেইন শেল্টারের আর্ক মেশ শেল ইনস্টলমেন্ট ও পেইন্টিং কাজ শেষ হলেও পিসি এনডোরেন্স শিট ইনস্টলমেন্ট কাজ এখনো চলমান। পশ্চিম অর্থাৎ পতেঙ্গা প্রান্ত ও পূর্ব (আনোয়ারা) প্রান্তে ২ মেগাওয়াটের সাময়িক বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। উভয় প্রান্তে স্থাপন করা হয়েছে ১৫ মেগাওয়াটের সাব-স্টেশন। টানেল নির্মাণ এলাকার উভয় প্রান্তে সারফেসে মিঠা পানির প্রবাহের লক্ষ্যে দুটি করে মোট চারটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। ২৬ নভেম্বরের মধ্যে বাকি পূর্তকাজও শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
এছাড়া বিদ্যুৎ ও যান্ত্রিক বিভাগের কাজ এখনো শেষ হয়নি। উত্তর ও দক্ষিণ টিউবের ফায়ার প্রুপ বোর্ড ও ডেকোরেটিভ বোর্ড স্থাপনের কাজ শেষ হয়নি। টানেলের ইলেকট্রোমেকানিক্যাল ওয়্যার্সের মধ্যে কেবল কানেকশন, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, লাইটিং কাজ চলমান থাকলেও জেট ফ্যান ইনস্টলমেন্ট সম্পন্ন হয়েছে। উভয় প্রান্তের অ্যাপ্রোচ সড়কের ৫ হাজার ৩৫০ মিটার কাজ সম্পন্ন হয়েছে ৯৮ শতাংশ। তাছাড়া প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ৩৭৯ দশমিক ৪২৬১ একরের মধ্যে ৩৬৫ দশমিক ৩৯১১ একর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। আনোয়ারা প্রান্তের নতুন প্রস্তাবিত ১৪ দশমিক শূন্য ৩৫ একর ভূমির যৌথ তদন্তের ফিল্ডবুক চূড়ান্তের কাজ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চলমান। ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত ২ হাজার ৮৭১ ব্যক্তির মধ্যে ২ হাজার ৩১৫ জনকে এরই মধ্যে ক্ষতিপূরণের চেক দেয়া হয়েছে। সার্ভিস এরিয়ার বাংলো, দুটি সেতু, ড্রেনেজ ও অভ্যন্তরীণ রোডসহ অন্যান্য কাজও চলমান। সার্ভিস এরিয়া নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে ৫৮ শতাংশ।
চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে কর্ণফুলীর তলদেশে এই টানেল নির্মাণ। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার হলেও এর সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের দুই পাশের ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার হাইওয়েকে যুক্ত করবে। তা ছাড়া টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি উড়াল সেতুও রয়েছে। টানেলে ১০ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের প্রতিটি টিউবের দূরত্ব অন্তত ১১ মিটার। দুই টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেনে চলাচল করবে যানবাহন। এসব টিউবের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩৬ মিটার। টিউবের ভেতরের উচ্চতা ১৬ ফুট।
চীনা অর্থায়নে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্পটির ঠিকাদার চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি)। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তাদের সঙ্গে ২০১৫ সালের ৩০ জুন চুক্তি হয়। পরে ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। পাঁচ বছর অর্থাৎ চলতি বছরের ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। কাজ সমাপ্তির পর দুই বছর ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড রয়েছে চুক্তিতে। ছবি: সংগ্রহ