চট্টগ্রাম, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২:
ফুটবলের রাজা ব্রাজিলিয়ান পেলে, ‘ কালো মানিক’ তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড যার তিনি গত বৃহস্পতিবার ৮২ বছর বয়সে মারা গেছেন। তার এজেন্ট জো ফ্রাগা তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ব্রাজিলে তার মৃত্যুতে তিন রাষ্্রটীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। সাও পাওলোর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে, যেখানে পেলে চিকিৎসাধীন ছিলেন সেখানে তিনি গতকাল বিকেল ৩টা ২৭ মিনিটে মারা গেছেন।
গত শতাব্দীর অন্যতম প্রধান ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব পেলে ২০২১ সাল থেকে কোলন ক্যান্সারের জন্য চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। এছাড়া একাধিক রোগে ভুগে গত মাস ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন৷
ব্রাজিলের এই কিংবদন্তি ফুটবলার পেলের গোলের মোট সংখ্যা- লিগ ম্যাচে ৬৫০টি এবং ১,২৮২ (সমস্ত সিনিয়র ম্যাচ ও কিছু নিম্ন-স্তরের প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে)।
ফুটবলের রাজা পেলে ১৭ বছর বয়সে সুইডেনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে প্রথমে খেলতে নামেন। যখন তিনি এই টুর্নামেন্টের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। ফাইনালে স্বাগতিক দেশের বিপক্ষে ব্রাজিলের ৫-২ ব্যবধানে জয়ের খাতায় তিনি দুটি গোল করেন। এই জয়ের আনন্দে তাকে সতীর্থরা কাঁধে তুলে বিজয় উদযাপন করে।
১৯৬২ সালে ব্রাজিল যখন বিশ্ব শিরোপা ধরে রেখেছিল তখন ইনজুরির জন্য মাত্র দুটি ম্যাচে মাঠে নামেন। কিন্তু ১৯৭০ সালে তার দেশের বিশ্বকাপ জয়ের প্রতীক পেলে নিজেই। তিনি ফাইনালে গোল করেন এবং ইতালির বিপক্ষে ৪-১ গোলের বিজয়ী হয়।
পেলের খ্যাতি এমন ছিল যে ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়ায় একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার উপলক্ষকে ঘিরে নাইজেরিয়ায় গৃহযুদ্ধকারীরা সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। উত্তর আমেরিকায় গেমটিকে জনপ্রিয় করতে সাহায্য করার জন্য তিনি যখন ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্টই প্রথম তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ‘আমার নাম রোনাল্ড রিগান, আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি,’ পরিচয় দিয়ে। রিগান বলেছিলেন, ‘কিন্তু আপনার নিজের পরিচয় দেওয়ার দরকার নেই কারণ সবাই জানে পেলে কে।’
পেলে ছিলেন ব্রাজিলের প্রথম আধুনিক কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয় নায়ক। ফুটবলের পরে পেলের জীবন অনেক রূপ লাভ করে। তিনি একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন— ব্রাজিলের ক্রীড়া বিষয়ক অসাধারণ মন্ত্রী — একজন ধনী ব্যবসায়ী এবং ইউনেস্কো এবং জাতিসংঘের একজন রাষ্ট্রদূত।
তিনি চলচ্চিত্র, সোপ অপেরা এবং এমনকি গান রচনা করেছিলেন এবং জনপ্রিয় ব্রাজিলিয়ান সঙ্গীতের সিডি রেকর্ড করেছিলেন।
তার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ার সাথে সাথে তার ভ্রমণ এবং সর্বত্র উপস্থিতি কমে আসে। শেষ বছরগুলিতে তাকে প্রায়ই হুইলচেয়ারে দেখা যেত এবং ব্রাজিলের ১৯৭০ বিশ্বকাপ দলের প্রতিনিধিত্বকারী তার একটি মূর্তি উন্মোচনের অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। পেলে তার ৮০তম জন্মদিন সৈকত বাড়িতে পরিবারের কয়েকজন সদস্যের সাথে বিচ্ছিন্নভাবে কাটিয়েছেন।
১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর মিনাস গেরাইস রাজ্যের অভ্যন্তরস্থ ছোট শহর ট্রেস কোরাকোয়েসে জন্মগ্রহণ করেন এডসন আরন্তেস ডো নাসিমেন্টো। ১১ বছর বয়সে তার ফুটবল প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। একজন স্থানীয় পেশাদার খেলোয়াড় তাকে সান্তোসের যুব দলে নিয়ে আসেন। এরপর সিনিয়র দলে জায়গা করে নিতে তার বেশি সময় লাগেনি।মাত্র ৫ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার এই খেলোয়াড় পেলে প্রাপ্তবয়স্ক খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে সমান তালে লড়াই করতে পারতেন। ১৯৫৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি ব্রাজিলিয়ান ক্লাবে খেলতে শুরু করেন। ক্লাবটি দ্রুত বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে।
তিনি রিজার্ভ হিসাবে ১৯৫৮ এর বিশ্বকাপে যোগ দেন। এই সময়ে তার দেশের চ্যাম্পিয়নশিপ দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়েছিলেন। তার প্রথম গোল, যেখানে তিনি বলটি একজন ডিফেন্ডারের মাথার উপর দিয়ে ফ্লিক করেন এবং তার চারপাশে ভলি করতে করতে দৌড় দেন, বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা গোল হিসেবে ছিল এটি। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপ পেলের কাছে তিক্ত এক অভিজ্ঞতা ছিল। যখন ব্রাজিল গ্রুপ পর্বে ছিটকে যায়। সেই সময় পেলে সেটাই তার শেষ বিশ্বকাপ বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু তিনি সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। পরে ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ জয় করেন।
তিনি ইতালির বিপক্ষে ফাইনালে উদ্বোধনী গোলটি করেন, এটি তার শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ। সব মিলিয়ে, পেলে ব্রাজিলের সাথে ১১৪ টি ম্যাচ খেলে রেকর্ড ৯৫টি গোল করেছেন, যার মধ্যে ৭৭টি অফিসিয়াল ম্যাচ রয়েছে। সান্তোসের সাথে খেলোয়াড়ি জীবন শেষে তিনি অবসরে যান। অবসর ভেঙ্গে ইউরোপীয় ক্লাবগুলো তাকে কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু ব্রাজিল সরকার তাকে জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করে বিক্রি থেকে বিরত রাখতে হস্তক্ষেপ করে।
তার আত্মজীবনী, “মাই লাইফ অ্যান্ড দ্য বিউটিফুল গেম” গ্রন্থ লিখে সেখানেও তিনি তার খেলোয়াড়ি জীবনের সমস্ত কাহিনী আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরেন।
পেলে ১ অক্টোবর, ১৯৭৭ সালে স্যান্টোসের মধ্যে একটি প্রদর্শনীতে নিউ জার্সির প্রায় ৭৭০০০ জনতার সামনে তার কর্মজীবনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
পেলে তার ব্যক্তিগত জীবনে কঠিন সময় সহ্য করেছেন- বিশেষ করে যখন তার ছেলে এডিনহোকে মাদক সংক্রান্ত অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। পেলের বিবাহ সম্পর্কের দুটি কন্যা এবং তার প্রথম দুটি বিবাহ থেকে রোসেমেরি ডস রেইস চোলবি এবং অ্যাসিরিয়া সেক্সাস লেমোসের পাঁচটি সন্তান ছিল। পরে তিনি ব্যবসায়ী মার্সিয়া সিবেলে আওকিকে বিয়ে করেন।
Discussion about this post