চট্টগ্রাম, ৫ জানুয়ারি, ২০২৩:
গাড়ি থেকে রপ্তানিমুখী পোশাক চুরির অপরাধে শাহেদ নামে এক গ্যাং লিডারকে গ্রেপ্তারের পর তার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। এই শাহেদ তার দলবল নিয়ে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামবন্দরগামি রপ্তানিমুখি পোশাকের গাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা মূল্যের কাপড় চুরি করেছে।
গ্রেপ্তারের পর শনিবার সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, শাহেদ এখন ৪০-৫০ সদস্যের একটি গ্যাং পরিচালনা করে। গত শুক্রবার মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকায় অভিযান চালিয়ে তৈরি পোশাক চুরির মূল পরিকল্পনাকারীসহ চারজনকে গত আটক করে র্যাব।
গ্যাং লিআর গ্রেপ্তার শাহেদ ওরফে সাঈদ, বোদ্দা, ওরফে ‘সিলেটি সাঈদ’ নামেও পরিচিত, এই চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী বলে র্যাব জানায়।
চক্রটি প্রায় দুই হাজার কাভার্ড ভ্যান থেকে তৈরি পোশাক আইটেম চুরি করেছে।
শাহেদের মৌলভীবাজার শহরে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা মূল্যের একটি বাড়ির মালিক। প্রায় ২০ একর জমিতে মাছের খামারসহ তার দুটি বিশাল পোল্ট্রি ফার্ম রয়েছে। বর্তমানে শাহেদ ও তার সহযোগীদের 19টি কাভার্ড ভ্যান রয়েছে। র্যাব কর্মকর্তা জানান, তার দুই স্ত্রীর একজন তার সন্তানসহ লন্ডনে থাকে।
র্যাবের মঈন বলেন, বাংলাদেশে বেশির ভাগ আরএমজি চুরি হয়েছে শাহেদের জালে তার নির্দেশনায়।
গ্রেফতারকৃত শাহেদের অন্য সহযোগিরা হল- ঢাকার উত্তরা এলাকার আরএমজি পণ্যের স্টক লট ব্যবসায়ী ইমারত হোসেন সজল, শাহেদের ভ্যানের চালক ও হেলপাদের মধ্যে শাহজাহান ও হৃদয় প্রায় শতাধিক চুরির সঙ্গে জড়িত।
সম্প্রতি ব্রাজিলে রপ্তানি করা আরএমজি পণ্য চুরির সঙ্গে জড়িত ছিল শাহেদের গ্যাং।
আরএমজি প্রস্তুতকারক এ প্লাস সোয়েটার লিমিটেড১.২৫ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের একটি চালান পাঠিয়েছিল। ৮৯৮ কার্টনে বস্তাবন্দী সোয়েটারের চালানটি গত বছরের ২৯ অক্টোবর তার গাজীপুর কারখানা থেকে ৮ টি কাভার্ড ভ্যানে করে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়েছিল, ব্রাজিলের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড মিরসা ক্রেতার কাছে চালানের জন্য। কিন্তু এ প্লাস গ্রুপ কর্তৃপক্ষ ৬ জানুয়ারি ব্রাজিলিয়ান ক্রেতার কাছ থেকে ভিডিও ফুটেজ পাওয়ার পরে হতবাক হয়ে যায়, যা দেখায় যে কিছু কার্টন সম্পূর্ণ খালি বাক্স ছিল এবং অনেকের অনেক পণ্য হারিয়ে গেছে।
এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চুরির তদন্ত শুরু করে। ব্রিফিংয়ে আলাপকালে মঈন বলেন, বাংলাদেশে বেশির ভাগ আরএমজি চুরি হয়েছে শাহেদের জালে তার নির্দেশনায়। শাহেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় আরএমজি চুরির ১৭-১৮টি মামলা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ছয়টি মামলা এখনও আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
মঈন জানান, গার্মেন্টস পণ্য পরিবহনের সাথে জড়িত কাভার্ড ভ্যানের চালক ও হেলপারদের সাথে এই চক্রের সদস্যরা প্রথমে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে এবং অল্প সময়ের মধ্যে মোটা অংকের টাকা আদায়ের প্রলোভন দিয়ে পণ্য চুরি করতে উৎসাহিত করে। চালক এবং তাদের সহকারীরা আরএমজি আইটেমের নমুনার ফটো তুলতেন এবং তা গ্যাংয়ের সদস্যদের সাথে শেয়ার করতেন যারা বাজারে দাম নির্ধারণ করে দিতেন।
চালকরা সাধারণত বন্দরে যাওয়ার পথে কয়েক ঘণ্টার জন্য হাইওয়ের পাশের কিছু স্টোররুমে তৈরি পোশাক চুরি করে মজুদ করে। র্যাব কর্মকর্তা বলেন, গ্যাংয়ের সদস্যরা কাভার্ড ভ্যান থেকে 30-35 শতাংশ আরএমজি কাপড় চুরি করে।
র্যাব জানায়, সোয়া বছর আগে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে একই অভিযোগে সিলেটি সাঈদ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল । তার বিরুদ্ধে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চুরির ২৪টি মামলার হদিস মিলেছে, যেগুলোর মধ্যে ছয়টিতে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি কারাভোগও করেছেন। পুলিশ বলছে, পরিবহনকর্মী ও ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক চুরি করছেন। বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বের হয়ে একই কাজে যুক্ত হন আবার। সাঈদ আনুমানিক পাঁচ হাজার চুরির ঘটনার সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য দিয়েছিলেন। যার বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকা হতে পারে। চুরির টাকায় তিনি নামে-বেনামে কয়েকশ কভার্ড ভ্যান নামিয়েছেন, যেগুলো তার নেটওয়ার্কের মূল চালিকাশক্তি।
তার নিজস্ব গুদাম রয়েছে ঢাকা চট্টগ্রাম সড়কের সর্বত্র।যেখানে চুরি করা রপ্তানি পোশাক মজুত করা হত।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যে জানা যায়, সাঈদের গ্যাংয়ের সাথে পোশাক পরিবহনকারী কাভার্ড ভ্যানের চালক থেকে শুরু করে নানা চক্র রয়েছে। পোশাক বহনকারী ভ্যানের দরজা সিলগালা করা থাকলেও তারা ভ্যানের স্টিলের পাত খুলে ভেতর থেকে পুরো কার্টন চুরি না করে কার্টন খুলে প্রত্যেকটা থেকে কিছ কিছু কাপড় চুরি করে সেগুলো আবার ঠিকঠাকমত প্যাকিং করে দিত। এতে চুরি ধরার কোনো উপায় ছিল না। এসব পোশাক ক্রয়ের জন্য সা।দের সাথে কিছু বায়িং হাউজ যুক্ত ছিল।
ঢাকা চট্টগ্রাম সড়কে তৈরি পোশাক চুরির ৫টি গ্রুপ রয়েছে। এগুলো প্রত্যেকটার সাথে সাঈদের যোগসাজশ রয়েছে।
এবার যেভাবে গ্রেপ্তার সাঈদ: গাজীপুরের কোনাবাড়ীর একটি তৈরি পোশাক কোম্পানি গত বছরের ২৯ অক্টোবর এক চালানে ৮৯৮ কার্টন সোয়েটার পাঠায় ব্রাজিলে। ৬ জানুয়ারি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান একটি ভিডিও পাঠায় কারখানা কর্তৃপক্ষকে, যাতে দেখা যায়- প্রতিটি কার্টন থেকে অনেকগুলো করে পণ্য নেই। অনেকগুলো কার্টন একেবারেই খালি। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, কার্টনের গায়ে লেখা ১০টি করে পণ্য রয়েছে তাতে। ইনট্যাক্ট কার্টন কাটার পর দেখা যাচ্ছে তাতে তিন বা চারটি করে পণ্য রয়েছে। ওই ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষ গাজীপুরের গাছা থানায় মামলা করে।
ওই মামলায় মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশে অভিযান চালিয়ে ‘হোতা’ সাঈদ ওরফে বদ্দা, ইমারত হোসেন সজল, শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ ও হৃদয়কে চুরি যাওয়া পণ্যসহ গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
তবে সাঈদ এর আগে আরও ৬ বার গ্রেপ্তার হয়েছে। জেল কেটেছে কিছু সময়। কিন্তু শত শত কোটি টাকার রপ্তানি পোশাক চুরি কখনো বন্ধ হয়নি।
Discussion about this post