চট্টগ্রাম, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩:
বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের স্বপ্ন ছিল দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও বেগবান করতে এবং বন্দরের খরচ কমাতে এটার প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত বেশি। অন্যদিকে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের সক্ষমতারও একটি বড় প্রমাণ। সেই গভীর সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামের কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতাবাড়িতে নির্মাণ হতে চলেছে।
এই গভীর সমুদ্র বন্দর নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির চালে পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। বিশেষ করে চীন ও ভারতের রাজনীতি মুখে পড়ে সরকার। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে জাপানের সহায়তায় বাংলাদেশ তৈরি করছে গভীর সমুদ্র বন্দর। মাতারবাড়ি কয়লা বিদু্যৎ প্রকল্প করতে গিয়েই স্থানটি গভীর সমুদ্র বন্দর করার জন্য বিবেচনায় উঠে আসে। এরপর তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যকে আরও শক্তিশালী করার ইতিহাস রচনা করবে।লেখাটিতে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের একটি চিত্র যেমন তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতে এটির সম্প্রসারণের বিষয়টিও আলোকপাত করা হয়েছে। এই সমুদ্র বন্দরের কাজ শুরু হবে আগামী জুলাই-আগস্টে। ইন্টানেটের তথ্য সহায়তা নিয়ে লেখাটি লিখেছেন-
প্রান্তিক দাশ
বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী খ্যাত কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটার মাতারবাড়িতে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। কর্ণফুলী নদীর গভীরতা কম হওয়ায় দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে মাদার ভেসেলগুলো ভিড়তে পারে না। যার কারণে গভীর সমুদ্র থেকে অথবা শ্রীলঙ্কা বা সিংগাপুর পোর্ট থেকে ফিডার ভেসেলে পণ্য আনা নেওয়ার মাধ্যমেই ইম্পোর্ট এক্সপোর্ট কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে এভাবে পণ্য আনা নেওয়া করাতে বাড়তি সময় লাগার পাশাপাশি বেড়ে যায় খরচও।
দেশের প্রধান সমুদ্র চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের পরিমাণ প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দরের উপর কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের চাপ কমাতে এবং কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংর খরচ কমিয়ে এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টকে বুস্ট করতে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটির পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ইকোনমিক জোনও। যার কারণে এক্সিস্টিং বন্দরগুলোতে চাপ কমানো ছাড়াও আরও নানা দিক থেকে মাদারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর বিশ্বের অর্থনীতিতে উল্লেখ্যোগ্য ভূমিকা পালন করবে।
২০১৮ সালে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটার মাতারবাড়িতে জাইকার সহায়তায় মাতারবাড়ি কোলফায়ার পাওয়ার প্লান্টের কাজ শুরু হয়। কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট হওয়ায় সেখানে কয়লা আনার জন্য একটি জেটি নির্মাণের জন্য জাইকার ফিজিবিলিটি স্টাডির রিপোর্টে দেখা যায় যে মাতারবাড়ির ওই এলাকায় সমুদ্রের গভীরতা ১৫.৫ মিটার এবং কিছুদূর এগোলেই গভীরতা ৩০ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যায়। যা একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য আদর্শ।
মূলত সেখান থেকেই দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য মাতারবাড়িকে সাজেস্ট করে জাইকা। এর আগে অবশ্য গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য চীনের পরামর্শ অনুযায়ী সোনাদিয়া দ্বীপকে চিন্তা করা হলেও পরবর্তীতে পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু সেখানেও চ্যানেলের ৭০ কি.মি. এলাকায় ড্রেজিং করতে প্রতি বছর প্রচুর টাকা খরচ হবে বিধায় প্রকল্পটি আটকে ছিলো। মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের চলমান মেঘা প্রজেক্টগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রজেক্ট।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরে দুটি জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে যার একটি হবে ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যের কন্টেইনার জেটি এবং অপরটি হবে ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের মাল্টিপারপাস বা ভালব জেটি যেখানে সকল ধরনের পণ্য উঠা নামা করা যাবে। জাইকার অর্থায়নে ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে জাইকা ১২ হাজার ৮৯২ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার ২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে।
ইতোমধ্যে এই পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে মোট ২৮৩.২৭ একর জমি অধিগ্রহণ সফলভাবে সম্পন্ন করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটির প্রথম ফেইজের প্রথম ধাপে ২৯.১৫ একরের ব্যাক ইয়ার্ডসহ ৩০০ মিটারের একটি মাল্টিপারপাস জেটি এবং ৫০ একরের ব্যাকইয়ার্ডসহ ৪৬০ মিটারের একটি কন্টেইনার জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া বন্দরে প্রবেশের জন্য ৩৫০ মিটারের একটি চ্যানেল নির্মাণ করা হবে যার মধ্যে ২৫০ মিটার মাতারবাড়ির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা জেটির জন্য এবং বাকি ১০০ মিটার মাতারবাড়ি বন্দরের জন্য নির্মাণ করা হবে।
বন্দরের শেষ হতে ২০২৫ সালের জুন মাস নাগাদ লাগতে পারে বলে চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটির একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়। প্রথম ফেইজের দ্বিতীয় ধাপে বন্দরের টার্নিং ভেসেল দক্ষিণ দিকে আরো বাড়ানো হবে এবং ১২৩.৫৫ একর ব্যাক ইয়ার্ডসহ মোট ১০৫০ মিটারের ৩ টি কন্টেইনার জেটি তৈরি করা হবে। বন্দরের অতিরিক্ত অংশটি ট্রাক পার্কিং, ওয়ারহাউস তৈরি, লজিস্টিক পার্ক এবং এক্সেসরিস সার্ভিসের জন্য ব্যবহার করা হবে। তাছাড়া মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরের দ্বিতীয় ফেইজের কাজ কুহুলিয়া নদীর পাশে করার জন্য রিকমেন্ড করা হয়েছে। যেখানে গভীর সমুদ্র বন্দরের পশ্চিম পাশে ১৩১ একরের ব্যাক ইয়ার্ডসহ মোট ১০৫০ মিটারের ৩টি কন্টেইনার জেটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া এই অংশের এক্সেস চ্যানেলের গভীরতা এবং ভেসিনের গভীরতা ১৬ মিটার রাখা হবে। ইতোমধ্যে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের অধীনে ৩ টি জেটির জন্য ২৫০ মিটার চ্যানেলের কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া চ্যানেলের ভিতরে থাকা সমুদ্রের পানি শান্ত রাখতে এবং ঠাণ্ডা হওয়া থেকে মুক্ত রাখতে কোল্ড পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে ২৫০০ মিটার লম্বা একটি সেনিমেন্ডেশন মেডিকেশন টাইপ তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ২৫০০ মিটারের আরো একটি ব্রেক ওয়াটার ইতোমধ্যে তৈরি করেছে সিপিজিসিবিএম। তবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য এই ব্রেক ওয়াটারের চাইতে আরো ৩৯৭ মিটারের লম্বা আরো একটি ব্রেক ওয়াটারের প্রয়োজন রয়েছে। যার কাজও সিপিজিসিবিএম এর অধীনে সম্পন্ন করা হবে। আনুমানিক ২০২৬ সাল নাগাদ এই বন্দরের সকল কার্যক্রম সম্পন্ন হবে বলে ধারণা করছেন কতৃপক্ষ।
মাতাবাড়ি বন্দরের যেসব সুবিধা পাওয়া যাবে :
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে এখানে সর্বোচ্চ ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার ইইউজ কন্টেইনার ক্যাপাসিটির, ১৬ মিটার ড্রাফটের শিপ বা মাদার ভেসেলগুলো সহজেই বন্দরে ভিড়তে পারবে। সমুদ্র পথে বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোর কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের ক্যাপাসিটিও শিগগিরই বাড়ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে জাহাজ আগমন বৃদ্ধির হার ১১ শতাংশের বেশি। অন্য দিকে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলো বছরে প্রায় ৩৩ লক্ষ টি ই ইউ কন্টেইনার হ্যান্ডেল করে। যার মধ্যে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম একাই হ্যান্ডেল করেছে সাড়ে ৩২ লক্ষ টি ই ইউ কন্টেইনার। বর্তমানে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে বার্ষিক কন্টেইনার হ্যান্ডেলের ক্যাপাসিটি যথাক্রমে ৪০ লক্ষ টি ই ইউ এবং ২ লক্ষ টি ই ইউ। চট্টগ্রাম পোর্ট অথরিটির তথ্য অনুসারে আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে বার্ষিক কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪০লক্ষ টি ই ইউজ। ফলে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের অতিরিক্ত চাপ কমানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির সাথে পাল্লা দিতে মাতারবাড়ি ডিপ সী পোর্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে ২০২৬ সালে মাতারবাড়ি ডিপ সী পোর্টের কন্টেইনার টার্মিনালের বাৎসরিক ক্ষমতা হবে ৬ লক্ষ থেকে ১১ লক্ষ টি ই ইউজ যা ২০৪১ সাল নাগাদ ১৪ লক্ষ থেকে ৪২ লক্ষ টি ই ইউজে পৌঁছোবে। এছাড়া জায়গার সমীক্ষা অনুযায়ী মাতারবাড়ি টার্মিনালে প্রতি ২০ কন্টেইনারের জন্য ১৩১ ডলার এবং ৪০ ফুট কন্টেইনারের জন্য প্রায় ২০০ ডলার খরচ কমবে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কোনো পণ্য এক্সপোর্ট বা দেশি পণ্য ইম্পোর্ট করার জন্য ভারত, শ্রীলঙ্কা বা সিংগাপুরের ডিপ সী পোর্ট ব্যবহার করে। কেননা বাংলাদেশে কোনো ডিপ সী পোর্ট না থাকায় কোনো মাদার ভেসেলগুলো সমুদ্র বন্দর গুলোতে প্রবেশ করতে পারে না। যার কারণে এক্সপোর্টের জন্য দেশের বন্দরগুলোতে ফিডার ভেসেলে করে পণ্যবাহী কার্গোগুলো প্রথমে উক্ত দেশের পোর্টে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে মাদারভেসেলে তা লোড করতে হয়। এবং ফিডার ভেসেলগুলো ফিরার পথে ইম্পোর্টারদের কার্গো নিয়ে ফিরে আসে। দূরত্বের কারণে এক্সপোর্ট বা ইম্পোটের জন্য এই বন্দরগুলো থেকে পণ্য পরিবহনের খরচ ও সময় অনেক বেশি বেড়ে যায়। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর অপারেশনাল হওয়ার পরে যেহেতু মাদার ভেসেলগুলো এই বন্দর এসে ভিড়তে পারবে তাই সমুদ্র পথে সামগ্রিক পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে প্রায় ১৫ শতাংশ। খরচের সাথে যেহেতু সময় ও কমবে তাই দেশের এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ম্যানুফ্যাকচারাররাও এর সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছাড়াও আরো বেশ কিছু পরোক্ষ প্রভাবও রয়েছে।
মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরত্বে ধলঘাটায় ৩৫০০ একর জমিতে ইতোমধ্যেই মহেশখালী ইকোনমিক জোন তৈরি হচ্ছে। এই ইকোনমিক জোনটি অপারেশনাল হলে অনেক দেশী-বিদেশী কোম্পানি এখানে তাদের প্রডাকশন ও ম্যানুফ্যাকচারিং বিজনেস এস্টাব্লিশ করবে। যার কারণে সৃষ্টি হবে প্রচুর পরিমাণে নতুন কর্মসংস্থানের। এছাড়া মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরের এতো কাছে হওয়াতে মহেশখালী ইকোনমিক জোনের প্রডাকশন বা ম্যানুফ্যাকচারিং রিলেটেড কাঁচামাল সহজে আমদানি করা সহজ হবে। আবার এই ইকোনমিক জোনে প্রস্তুতকৃত পণ্য গুলো মাতারবাড়ি পোর্ট ব্যবহার করে দেশের অন্যান্য এলাকায় ট্রান্সফার করা থেকে শুরু করে বিদেশেও সরাসরি এক্সপোর্ট করা সম্ভব হবে। যা পণ্য পরিবহন ও এক্সপোর্ট এর সময় অনেকাংশে কমিয়ে আনবে।
এছাড়া এই সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাবে ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, ভূটান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও চীনের মত প্রতিবেশী দেশগুলো। বাংলাদেশের সাথে ইতোমধ্যে ভারতের ২৩ টি স্থলবন্দর রয়েছে যার মধ্যে ১১ টি বর্তমানে অপারেশনাল রয়েছে। ভারত চাইলে পণ্যবাহী জাহাজগুলো মাতারবাড়ি বন্দরে পণ্য খালাস করে সেখান থেকে নিকটস্থ স্থলবন্দর ব্যবহার করে সহজে এবং কম সময়ে পণ্য নিয়ে যেতে পারবে। ভারত ছাড়া মিয়ানমারের সাথেও বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে টেকনাফে একটি স্থলবন্দর রয়েছে যা মাতারবাড়ি থেকে ১০৮-১১০ কিমি. দূরত্বে। যা ব্যবহার করে মিয়ানমার এমনকি চায়নাও তাদের এক্সপোর্ট ইম্পোর্ট সম্পন্ন করতে পারবে। এইভাবে বাংলাদেশের ট্রানজিট ডিউটি করে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব আয়ের দ্বার উন্মোচন হবে। ফলে দেশের অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। এর পাশাপাশি মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের কারণে বাংলাদেশ একটি এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট হাব হয়ে উঠবে। মাতারবাড়ি বন্দরে কয়লা, এলএনজি, সিমেন্ট, ষ্টীল এবং লোহা জাতীয় পণ্য এবং স্ক্র্যাপ ম্যাটাল ইম্পোর্ট করার জন্য আলাদা আলাদা টার্মিনাল ও জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। মাতারবাড়ি বন্দরের কোল ট্রান্সমিশন টার্মিনাল বা সিটিটি এর মাধ্যমে ২০২৬ সালে বার্ষিক ৯ মিলিয়ন টন ২০৩১ সাল নাগাদ ১৪ মিলিয়ন টন ও ২০৪১ সাল নাগাদ ৪১ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করা যাবে। এছাড়া ২০২৬ সালে প্রতিদিন ৪৭০০ মিলিয়ন কিউবিক ফিট এলএনজি মাতারবাড়ি বন্দরের এফএসআরইউ টার্মিনালের মাধ্যমে আমদানি করা যাবে। বন্দরটির আউটার এনকরিং এরিয়াতে একটি সিংগেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল তৈরি করা হচ্ছে যার মাধ্যমে বড় বড় ট্যাংকারে করে ক্রুড অয়েলও আমদানি করা যাবে। এছাড়া দেশের চলমান ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্টগুলোর জন্য অনেক বেশি সিমেন্টের প্রয়োজন হয় যা ইম্পোর্ট করতে হয়। ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে ২৪ মিলিয়ন টন ক্লিংকার ইম্পোর্ট করা হয়েছিল। এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সিমেন্ট ক্লিংকার ইম্পোর্ট এর পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন টন। তাছাড়া ২০২৬ সাল নাগাদ স্টিল প্রডাক্ট এবং স্ক্র্যাপ আইরনের আমদানির পরিমাণ ৯.৯ মিলিয়ন টনে পৌঁছাবে এবং যা ২০৪১ সাল নাগাদ ১৭.৮ মিলিয়ন টন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে ফার্টিলাইজার সিরয়াল, চিনি ও গমের মত খাদ্য শস্যের আমদানিও প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর অপারেশনাল হলে এই সকল পণ্যের আমদানি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ূভূমিকা রাখতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই বন্দরের সাথে সমগ্র দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ সংযোগ ও একটি মুখ্য বিষয়। আর এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফাসিয়াখালি থেকে চকরিয়া উপজেলার বদরখালি বাজার হয়ে মহেশখালী উপজেলায় নির্মিত মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত ২০.৬৫ কি.মি দৈর্ঘ্যের একটি সড়ক নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর। তাছাড়া এই নতুন সড়কে মাঝারি ও দীর্ঘ মিলিয়ে ১৭ টি নতুন সেতু এবং প্রকল্প এলাকার সাইক্লোন ও জলোচ্ছাসের কথা মাথায় রেখে উচু সড়ক ও বাধ নির্মাণ করা হবে।এতেকরে মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরে আসা সকল পণ্য এই রাস্তা ব্যবহার করে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে পৌঁছাতে পারবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য পরিবহন বেশ সহজ ও কম সময়ে সম্ভব হবে। সড়ক পথ ছাড়াও বর্তমানে এডিবির অর্থায়নে চলমান দোহাজারি কক্সবাজার রেলওয়ে প্রজেক্টের সাথেও মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরকে সংযুক্ত করা হবে। বন্দর প্রকল্পের প্ল্যান অনুযায়ী একটি ডুয়েল গেইট রেলওয়ে রুট তৈরি করা হবে। এবং রেল মন্ত্রণালয়ের করা ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল প্রজেক্ট প্রিপ্রাইটির ফ্যাসিলিটিস স্টাডিতেও দোহাজারী-কক্সবাজার নেটওয়ার্কে মহেশখালী দ্বীপ পর্যন্ত এক্সপান্ড করার প্ল্যান উল্লেখ রয়েছে। ফলে সড়ক পথের পাশাপাশি রেলপথেও সহজে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মাতারবাড়ি বন্দর থেকে পণ্য খালাস করে তা ট্রান্সপোর্ট করা যাবে।এছাড়া বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়াতে পরো দেশ জুড়ে কয়েকশ ন্দী পথ রয়েছে। এই নদী পথ ব্যবহার করে ছোট ছোট ফিডার ভেসেলের মাধ্যমে মাতারবাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ এর পান গাঁও বন্দরসহ দেশের ভিতরেও অন্যান্য নৌবন্দরেও অল্প খরচে মালামাল পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের যে ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব মাতাবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর সেই ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ছবি: সংগ্রহ
Discussion about this post