চট্টগ্রাম, ২৫ মার্চ, ২০২৩:
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের আগে পরে বাংলাদেশে যে ভয়ঙ্কর চিত্র- একদিকে গণহত্যার নৃশংসতা, অন্যদিকে বাঙালির প্রতিরোধ লড়াই আর উদ্বাস্তু সন্ত্রস্ত মানুষের স্থানান্তরের লড়াই ছিল বিশ্বের কাছে এক অভাবনীয় যুদ্ধের প্রাকলগ্ন। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়ার সমস্ত বাঙালির এই প্রস্তুতি পর্বে উত্তাল হয়ে উঠেছিল পশ্চিম বাংলা তথা গোটা ভারত। এপাড় বাংলা আর ওপাড় বাংলার চিত্র মেলানো না গেলেও এপাড়ের বাঙালির জন্য প্রাণান্ত হয়ে উঠেছিল ওপাড়ের বাঙালি। একপক্ষ প্রাণ বাঁচানোর জন্য দিকবিদিক ছুটেছিল আর অপর পক্ষ এই সন্ত্রন্ত ও অধিকারবঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য লড়াই করার জন্য গর্জে উঠেছিল।
তাদের এই গর্জন ভারত মহাসাগরের কূল আছড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বিশ্বে। ভারতের সকল রাজনৈতিক দল ভেদ-বিভেদ ভুলে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দাবিদাওয়া ভুলে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সহায়তা করার জন্য ভারত সরকারের কাছে বার বার দাবি জানায়। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে বাংলাদেশের উদবাস্তুদের খাওয়া-থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয় পশ্চিম বঙ্গের সর্বস্তরের পেশাজীবী, সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, কারখানার শ্রমিক, দোকানদার, মুঠে-মজুর সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের জন্য লড়াই করেছে। মার্চ এপ্রিলে অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যুদ্ধে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে সহায়তা করেছে। ভারতের অনেক সাংবাদিক বাঙালির মুক্তি আকাক্সক্ষাকে নিজেদের মুক্তির সোপান মনে করেছে। এই যুদ্ধে ভারতের কয়েকজন সাংবাদিক নিখোঁজও হয়েছিল। বাঙালির জন্য বাঙালির এই অবেগ ছিল যেন এক চিরায়ত হৃদ্যতার সাক্ষ্য।
২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইটের খবরে ২৭ মার্চ থেকে পশ্চিম বঙ্গ উত্তাল হয়ে উঠে। ২৮ মার্চ দৈনিক যুগান্তরে সংবাদ শিরোনাম করা হয় ‘বাংলাদেশে পাক সেনাদের হত্যাকা-ের প্রতিবাদে পশ্চিম বঙ্গে সভা ও মিছিল’- এই সংবাদে জানানো হয়-‘২৭শে মার্চ-সমাজের সর্বস্তরের মানুষ আজ পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে সভা-সমিতি আর বিক্ষোভ মিছিলে “পরম আত্মীয় মুজিবরকে অকুন্ঠ সমর্থন জানায়’’। মুজিবরের জয়ধ্বনিতে মহানগরী আজ মুখরিত ছিল। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ধর্মঘট করে। পথে ১৪৪ ধারা অমান্য করে তারা পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশন অফিসের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ জানায়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কুশপুত্তলিকা দাহ করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সভা এদিন প্রস্তাব নিয়েছে বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবরের নিরাপত্তাবিধানের জন্য ভারত সরকার অবিলম্বে জাতিপুঞ্জের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করুন।
রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র-শিক্ষক- যুবক এবং শিক্ষাবিদগণ সকলে দলমত নির্বিশেষে ‘জাতীয়তাবাদী-নায়ক মুজিবরের’ নেতৃত্বে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন জানায়। জানোয়ার ইয়াহিয়ার গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে।
রাজনীতিবিদরা স্বাধীন বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানায় ভারত সরকারের কাছে। ছাত্র সমাজ গণহত্যার তীব্র নিন্দা জানায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো নানা কর্মসূচি পালন করে।
‘বাংলাদেশে গণ হত্যার প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতি’ শিরোনামে ২৮ মার্চে দৈনিক যুগান্তরের খবরে লেখক, সংস্কৃতিকর্মীরা ও বুদ্ধিজীবীরা বলেন, ‘শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে।’ এই মর্মে বিশদ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, আবু সায়ীদ আইয়ুব, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, শম্ভু মিত্র, সুশোভন সরকার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তৃপ্তি মিত্র, প্রবোধচন্দ্র সেন, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, অম্লান দত্ত, গৌরকিশোর ঘোষ, সন্তোষ কুমার ঘোষ, নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী। তারা বলেছেন, মুজিব আমাদের হৃদয় জয় করেছেন। এবং তারা মুক্তি সংগ্রামে বাংলাদেশের জয়ের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
২৭ মার্চ ছাত্র পরিষদও অনশন ধর্মঘট পালন করে বাংলাদেশের সমর্থনে। ছাত্র পরিষদ ডাঃ সুন্দরী মোহন এভেনিউ ও হাতিবাগান রোডের মোড়ে সারা দিন ব্যপী অনশন ধর্মঘট পালন করেন। কংগ্রেসের ডাকে ১০ থেকে ১৪ বছরের ছেলেরা অনশনের মাধ্যমে বিক্ষোভ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের তরুণদের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করায় জনসংঘ মশাল মিছিল করে। ২৭ মার্চ দিল্লি পাক হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে জনসাধারণ। পশ্চিম বাংলার জাতীয় দল প্রতিবাদ জানায়। নিখিল ভারত ফরোয়ার্ড ব্লক, ভারতীয় বার্তাজীবী সংঘ, বোম্বাই বাংলাদেশ সংহতি কমিটি, ট্রেড ইউনিয়ন, বোম্বাই লোকসেনা এভাবে বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবাদের বারুদ বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে জনগণ।
কলকাতার নাগরিক সমাজ বাংলাদেশে এসে যুদ্ধ করার শপথ নেয়। ডাক দেয়া হয় পশ্চিম বঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলার ।
যুগান্তর ২৯ মার্চের খবরে জানায়- বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তুলে বামদলগুলো। জ্যোতি বসু বলেন, ‘বাংলাদেশের যুদ্ধে সহযোগিতা করতে এক-দুইদিনের বেতন দিয়ে দিতে হবে। প্রস্তাবে পশ্চিম বাংলার মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করার কথা বলে। তিনি বলেন, ‘পূর্ব বাংলার লড়াই আমাদেরই লড়াই। তাদের পরাজয় আমাদেও পরাজয়।’
২৮ মার্চ হাওড়ায় নাগরিক সভার আয়োজন করা হয়। হাওড়ায় ছাত্ররা মিছিল বের করে। কংগ্রেসের সভায় ইন্দিরা গান্ধী ভারতের জনগণকে বাংলাদেশকে সহায়তা করার আহবান জানান। ৩০ মার্চে সর্বস্তরের জনতার সাথে কলকাতায় ডাক্তাররা মিছিল করে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে।
৩১ মার্চ বাংলাদেশের সমর্থনে সারা পশ্চিম বাংলায় হরতাল-ধর্মঘট পালন করা হয়। দৈনিক যুগান্তর লিখেছে-“বাংলা বিভক্ত হবার পর এই প্রথম এ- বাংলার বাঙালির প্রতি প্রকাশ্যে এবং সোচ্চারে সহানুভূতি ও সমর্থন জানালেন। দোকান-পাট, বাজার-হাট, কল-কারখানা বন্ধ রেখে, যানবাহন তুলে রেখে, সমস্ত আনন্দানুষ্ঠান বাতিল করে দিয়ে এ বাংলার বাঙালি তার একান্ত আপনজন ও বাংলার বাঙ্গালী বীর শহীদের প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধার নিদর্শনরূপে আজ ‘শোকদিবস’ পালন করে বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ও ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। পরম আত্মীয়ের বিয়োগ ব্যথায় মহানগরীর সর্বত্র আজ কালো পতাকা। পথের মোড়ে মোড়ে শহীদ বেদী। শ্বেতশুভ্র শহীদ বেদীগুলি ধূপধূনা আর ফুলে ফুলে সাজানো। শহীদ বেদীর পাশে অর্ধনমিত জাতীয় পতাকা। আর কালো পতাকা। নাগরিকদের বুকে কালো ব্যাজ। ”
সেদিন ধর্মঘট ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। যোগ দেন মহিলারা। হরতালে “দোকান-পাট বন্ধে কাউকে বলতে হয়নি। আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য বোমাবাজি করতে হয়নি। রেল লাইন অবরোধ করার আগেই ট্রেন বন্ধ করা হয় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে। হাওড়া-শিয়ালদা স্টেশন জনশূন্য। রিকশা চলেনি। লঞ্চ, ইস্টিমার, জাহাজ, বিমান কিছুই চলেনি। বৈমানিকরাও হরতাল সমথনে বিমান বন্ধ রাখে। সিনেমা থিয়েটার সব ছিল বন্ধ। যুব কংগ্রেস অনশনে বসে। মহিলারা মিছিলমিটিংয়ের ডাক দেয়। এমনকি প্রতিবাদ জানাতে শিখরাও সামিল হয়।
৩ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সম্পাদকীয় লেখা হয়। বিশ্বের কাছে তুলে ধরে বাংলাদেশে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিকা-ে বর্বরতার চিত্র- ‘একটি জোড়াতালির রাষ্ট্র মেজরিটি মাইনরিটিকে পায়ের তলায় থেতলাইয়া দিতে চায়’।
অবশ্য বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে কলকাতায় ২৩ মার্চ প্রথম প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী তার ‘একাত্তরের রাত দিন’ বইয়ে লিখেছেন, ‘ ২৩ শে মার্চ পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাধিকার সংগ্রামের সমর্থনে কলকাতা ইউনিভার্সিটির ইন্সটিটিউট হলে জনসভা হলো। ঐ কালপর্বে পূর্ব বাংলার মানুষের সমর্থনে প্রথম সভা। উদ্যোক্তা কমিউনিস্ট পার্টি। শ্রমিক নেতা মো. ইলিয়াছ, অজয় দাশগুপ্ত, অধ্যাপক অমিয় দাশগুপ্ত, ইলা মিত্র, এবং কবি তরুণ স্যানাল ছিলেন বক্তা।’
ওই সভার অ্যাসাইমেন্টে গিয়েছিলেন দিলীপ চক্রবর্তী। বক্তা অমিয় দাশগুপ্ত বলেছিলেন, পূর্ব বাংলার মানুষের এই সংগ্রাম একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই ঘটনা এই উপ মহাদেশে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে। বর্তমান সন্ধিক্ষণে সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষকে এই পরিবর্তনের পক্ষে তার নিজস্ব ভূমিকা নিতেই হবে। ’
ভারত এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেনি। সারা পৃথিবীকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের জুলুমের কথা জানিয়েছিল ভারতবাসী। প্রায় নয় মাস ভারতবাসীর সমর্থন নিয়েই ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক সমর্থনের জন্য গোটা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন।
আর তাতে বাঙালির বীরত্বের খবরও গোটা দুনিয়া জানতে শুরু করে। ৩ এপ্রিল সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি পদগর্নি বাংলাদেশের মানুষের উপর অত্যাচার ও রক্তপাত বন্ধের জন্য ইয়াহিয়ার কাছে টেলিগ্রাম করেন। এই সময়ে কলকাতার বহু তরুণ-তরুণি সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মিছিল নিয়েও সীমানা অতিক্রম করেছে অনেকে। দিলীপ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘তারা বাংলাদেশের মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করেছে। অনেকে মুঠো মুঠো মাটি সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে। তীর্থক্ষেত্রের মাটি সংগ্রহের মত।’ এভাবে তারাও বিদ্রোহ ও আবেগে মথিত হয়েছিল। যারা কখনো রক্ত দেয়নি তারাও লাইন দিয়েছিল যুদ্ধাহতদেরর রক্ত দানের জন্য।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ২৬ মার্চে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করা হলে সেই সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ৩০ মার্চ দাবি তোলে সিপিআই।
৩ এপ্রিল কলকাতা রাজ্য সরকার গঠনের মধ্যেই রাজ্য সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতি গঠন করা হয়। এটির সভাপতি ছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের অজয় মুখার্জী। গঠিত হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে সকল শিক্ষকরা এতে যুক্ত হলেন। উদ্বাস্তু সেবায় গঠিত হয়েছিল ন্যাশনাল রিলিফ অর্গানাইজেশন। পরিচয় পত্রিকা, আফ্রো-এশিয়া লেখক সংঘ, প্রগতি লেখক সংঘ, শান্তি সংসদের উদ্যোগে গঠিত হল বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতি। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা এই সংগঠনে আশ্রয় পেলেন। বাংলাদেশের উদবাস্তুদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রেডক্রস, আইএমএপিআরসি, ভারত সেবাশ্রম সংঘ, রামকৃষ্ণ মিশন, ইউনিয়ন, গণসংগঠন সহ অসংখ্য সংগঠন।
ততদিনে ভারতে ঢল নামে বাংলাদেশের ভয়ার্ত, সন্ত্রস্ত উদ্বাস্তু মানুষের। মার্চ থেকে ভারতে শরণার্থি যেতে শুরু করলে পশ্চিম বঙ্গের মানুষ তাদের স্বাগত জানিয়েছিল অত্যন্ত উষ্ণতার সাথে। দিন দিন এই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। দিনে ৩০ থেকে ৪০ হাজার শরণার্থির ঢল। যা শেষ পর্যন্ত কোটির অঙ্কে পৌঁছে ভারতের মাটিতে। ভারত সরকার ও জনগণ তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করলেও এক পর্যায়ে বেশ বিচলিত হয়ে পড়ে।
‘ইন্দিরা গান্ধী: বায়োগ্রাফিতে’ পুপুল জয়কর লিখেছেন,‘ ইন্দিরা আসাম, ত্রিপুরা ও বাংলার শরণার্থি শিবিরগুলো পরিদর্শনে যান এবং ২৪ শে মে তারিখে লোকসভায় ভাষণ দেওয়ার জন্য ফিরে আসেন। প্রায় পঁয়ত্রিশ লাখ শরণার্থি আট সপ্তাহের মধ্যে ভারত সীমান পার হয়ে চলে গেছে। তারা প্রতিটি ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট- হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান।…. ইন্দিরা বলেন: লিপিবদ্ধ ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এত বড় ধরনের, ভারী দর্শন দেশান্তরে যাওয়া নজিরবিহীন, অভূতপূর্ব। তারা শরণার্থি নয়- তারা যুদ্ধ অবস্থার শিকারে পর্যবসিত, যারা সামরিক আতঙ্ক থেকে সীমান্তের একদিক থেকে অন্যদিকে আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে’।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধি এই শরণার্থি দিয়েই বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছিল। যা এক কথায় বিস্ময়কর। ইন্দিরা গান্ধী এক সাক্ষাতকার বলেছেন, ‘বিশ্বকে আমরা যে তথ্য জানাই বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সেটা পাই বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের কাছ থেকে। ’
যদিও বাংলাদেশের শরণার্থী ভারতের অর্থনীতি সমাজ, প্রশাসন, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যের উপর বিরাটাকার বোঝা হয়ে উঠলেও তিনি ৭১ সালে বিশ্বব্যাপি ঘুরে একটি কথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন ‘উদ্বাস্তু সমস্যার মূল কারণ এড়িয়ে যদি উদ্বাস্তুদের উপর মনোযোগ গিয়ে পড়ে তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।’ তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে কারণে উদ্বাস্তু আসছে সেই কারণটা রোধ করতে হবে।
তখনকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের শরণার্থিদের খরচ সামাল দিতে তাদের দেশের জনগণকে কৃচ্ছতা সাধনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
তখনকার কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থমন্ত্রী ভারতের অর্থনীতি সংক্রান্ত এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘উদ্বাস্তুরা ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নতুন করগুলি প্রত্যাহার করে নেয়া হবে।’ কারণ শরণার্থীদের খরচ সামলাতে ভারতের জনগণের উপর অতিরিক্ত ৩০ শতাংশ কর ধার্য করেছিল।
যুদ্ধের সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিলেন ভারতে প্রতিদিন রাতে কত লোক না খেয়ে ঘুমাতে যান। যদিও ৭১ সালেই ভারত খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিল। কিন্তু ভারতের দারিদ্রতা ও বেকারত্ব চরম মাত্রায় তখনো। ইন্দিরা গান্ধি সেবার ক্ষমতা নেওয়ার পর পরই খড়ার মুখে পড়ে তার দেশ। মজুদ ঠিক রাখতে খাদ্য আমদানি করতে হত তাদের।
ভারতের এক কঠিন দুঃসময়ে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থির ঢেউ আছড়ে পড়েছিল মার্চ থেকে।
২৮ অক্টোবর কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রি শ্রী ওয়াই বি চ্যাবন প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় সুস্পষ্টভাবে জানান, নতুন যেসব
কর ধার্য করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ সাময়িক, পূর্ব বাংলার উদবাস্তুরা স্বদেশে ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তা প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। এই নতুন কর ধার্যের উদ্দ্যেশ্য কেবল অতিরিক্ত অর্থ সংগ্রহ করাই নয়, দেশবাসীকে সংকট সম্পর্কে অবহিত করাও।
ভারত সরকার থেকে বলা হয়েছিল-‘মানুষ শুধুমাত্র দরকারি জিনিস ক্রয় করবেন এবং অকারণে ব্যয় করবেন না। আমাদের, পুরুষ, নারী ও শিশুদের সবাই মূলত এক একজন সৈন্য। আমরা দেখতে চাই যে দেশ ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী। এই অন্ধকার দিনে আমরা শুধুমাত্র যদি সংযম ও কঠোরতা প্রয়োগ করব।’
ডিসেম্বর সময় পর্যন্ত উদবাস্তুদের ভরন-পোষণের জন্য মোট ৪৫০ কোটি টাকার দরকার। যদিও ভারত একটা আন্তর্জাতিক ট্রাস্ট হিসেবে উদ্বাস্তুদের ভরন পোষণের দায়িত্ব নিয়েছিল। আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুত ১২৫ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৩০ কোটি টাকা পেয়েছিল ভারত।
ভারতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘যথাসাধ্য চেষ্টা করছি শরণার্থীদের দেখাশোনার ব্যাপারে। পাশাপাশি আমরা বিদেশি সরকারগুলোর থেকে ও
নানারকম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সংস্থা থেকে এবং ব্যক্তিগতভাবে নাগরিকদের থেকে সাহায্য প্রার্থনা করেছি ও পাবো আশা করছি।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে প্রত্যেক স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িতে ১ জন পূর্ববাংলা থেকে আসা শরণার্থী অবস্থান নিয়েছে। ঘন জনসংখ্যার পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থিদের ব্যাপক অণুপ্রবেশে অনেক বড় সমস্যা তৈরি করে। রাজ্যের শিশুদের স্কুলগুলো শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান করার জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
উদবাস্তুদের প্রবল ¯্রােত বেসামাল হয়ে উঠার এক পর্যায়ে কোনো একটি নির্দিষ্ট রাজ্যে না রেখে কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ত্তে নিয়ে নেয় শরণার্থীদের। সীমান্তবর্তী ৫টি রাজ্যে শরণার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আর সকল রাজ্যে শরণার্থি ও মুক্তযোদ্ধাদের জন্য ত্রাণ তহবিল গঠন করা হয়েছিল। এমনকি রাজ্যের পোস্টকার্ড ও খামে অতিরিক্ত মাশুল বাড়ানো হয়। ২৯ মার্চ বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তুলে জ্যোতি বসু বলেন, ‘বাংলাদেশের যুদ্ধে সহযোগিতা করতে এক-দুইদিনের বেতন দিয়ে দিতে হবে।’ এভাবে ভারতের বহু চাকরিজীবী তাদের আয়রোজগারের টাকা বাংলাদেশের জন্য ব্যয় করে।
ভারতের অর্থনীতির উপর ব্যাপক নেতি প্রভাব পড়ে। মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
কেন বাংলাদেশকে এতটা সমর্থন দিয়েছিল তৎকালীন ভারত সরকার। কারণ- বিশেষ এই যে, ভারতের বাঙালিদের আবেগ ছিল তখন তুঙ্গে। পশ্চিম বাংলার মানুষও বাঙালি জাতির উপর মার্চের বর্বর হামলায় মুষড়ে পড়েছিল। মুষড়ে পড়েছিল গোটা ভারত। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের গ্রেপ্তার তারা মেনে নিতে পারেনি। মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশের বাঙালির গণহত্যার নৃশংসতা।
যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশ শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন খাদ্য,ঔষধ, কাপড় ইত্যাদি পাঠায়েছিল। ফ্রান্স, ইতালি, আমেরিকা সহ অনেক দেশের মানুষ সাহায্যের হাত বাড়ায়। এবং বিদেশে সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে শিশুকিশোরদের গ্রুপ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধিকে উদ্বাস্তুদের জন্য সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন বলে তিনি জানিয়েছিলেন। তিনি বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে বিশ্বের কাছে ঠিক সেভাবেই তুলে ধরেছিলেন।
তথ্যঋণ:
১. সংগ্রামের নোটবুক(অনলাইন ওয়েবসাইট)- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা
২.ইন্দিরা গান্ধী: বায়োগ্রাফি, লেখক -পুপুল জয়কর
৩.একাত্তরের রাত দিন, লেখক- দিলীপ চক্রবর্তী
৪.বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা, লেখক- তপন কুমার দে
Discussion about this post