চট্টগ্রাম, ২৯ এপ্রিল, ২০২৩:
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কথা এখনো ভুলেনি মানুষ। ৩২ বচর আগের সেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের মানুষ স্বজন-পরিজন ও সহায় সম্পত্তি ঘরবাড়ি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছিল। ‘ম্যারি এন’ নামের স্মরণকালের ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা এক লাখ ৩৮ হাজার দুইশ’ ৪২ জন। কিন্তু বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ছিল আরও বেশি।
উন্মত্ত বঙ্গোপসাগর সবকিছু তছনছ করে দিয়েছিল। সাগরের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিমিষেই বিধ্বস্ত করে উপকূলীয় জনপদ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পাশাপাশি চট্টগ্রাম নগরী, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, সন্দ্বীপ, পতেঙ্গা, আনোয়ারা, বাঁশখালী এবং কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, উখিয়া ও টেকনাফ উপকূলের লাখ লাখ মানুষ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল দিবাগত রাতে প্রকৃতির ভয়ঙ্কর ক্ষুধা মেটানোর বীভৎসতা দেখেছে।
রাতের আঁধারে ‘ম্যারি এন’ নামে নামাঙ্কিত প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর পানিতে ভাসতে থাকা নানা বয়সী মানুষ এবং গবাদি পশুর লাশের মর্মষ্পর্শী দৃশ্য কিংবা স্বজনের সাথে সহায়-সম্পদও হারানোর দুঃসহ যন্ত্রণা তাই আজও নাড়া দিয়ে যায় উপকূলবাসীর মনে। বছর ঘুরে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলে ভয়াল ২৯ এপ্রিল ফিরে এসেছে আজ। সেইসব দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে আজও ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে মন। খুঁজেফেরে হারানো স্বজন-রিজনের মুখ। তাদের সেই নানা অবয়ব। তবে প্রকৃতি একানব্বইয়ের মত আর ভয়াল ও বিধ্বংসী রূপকে এরপর আর দেখেনি। ৩২ বছরে আরও ঝড়জলোচ্ছ্বাস হলেও সেই সর্বগ্রাসী রূপ আর দেখেনি উপকূলের মানুষ।
‘ম্যারি এন’-এর কয়েক ঘন্টার তাণ্ডবলীলা সবকিছু ল-ভ- করে দিয়ে যাওয়ার পর উপকূলজুড়ে মানুষের লাশ পড়েছিল এখানে-ওখানে। শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করী এ ঘুর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চল মৃত্যুপূরীতে রূপ নেয়। চোখের পলকেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। ৩২ বছর পরও ঘূর্ণিঘড়ে উপকূলে স্বজনহারাদের আর্তনাদ একেবারে থেমে যায়নি। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়িয়ে বেড়ায় উপকূলবাসীকে। বছর ঘুরে কালবোশেখী কিংবা বর্ষা মৌসুমে নানা নামে নানা মাত্রার শক্তিধারী ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় অঞ্চলে এখনও আসে। প্রকৃতির ধ্বংসলীলায় সেদিন কোনও পরিবার হয়তো পুরোটাই নিশ্চিহ্ন হয়েছে, আবার কোনও পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই হারিয়ে গেছে সাগরের অতলে। এর মধ্যে সন্দ্বীপ, হাতিয়া এবং মহেশখালীতে নিহতের সংখ্যা ছিল বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর।
দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজ করা নানা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, গত দুই দশকে নগরীর পতেঙ্গায় শহররক্ষা বাঁধ, আনোয়ারা-বাঁশখালী অঞ্চলে বেড়িবাঁধসহ উপকূলীয় জনপদ ও মানুষের নিরাপত্তায় নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান সরকার উপকূলকে ব্যবহার করে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সুদূরপ্রসারী নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের পর চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলে যেসব সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ হয়েছিল তার একাংশ এখন ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষকে রক্ষায় নতুন সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ এবং টেকসই ও কার্যকর বেড়িবাঁধ নির্মাণের পদক্ষেপ নিতে বলেছেন অনেকে। সব পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবকে বিবেচনায় রাখারও তাগিদ দিয়েছেন তারা।
১৯৯১ সালের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস কেবল কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলাতেই অন্তত ২৫ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। মারা যায় লাখ লাখ গবাদি পশু। প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ উপকূলীয় এলাকা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিণত হয় বিরাণভূমিতে।
দিনটি ঘিরে উপকূলীয় এলাকার মানুষ তাদের হারানো স্বজনদের এখনো স্মরণ করে। মূলত সেই সময়ে টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় উপকূলীয় এলাকা রাতের মধ্যেই বিরাণভূমিতে পরিণত হয়েছিল। আর এখনও সেই অরক্ষিত অবস্থা কাটেনি। বেড়িবাঁধ নির্মাণকারী পানি উন্নয়ন বোর্ড পুরো উপকূল রক্ষায় টেকসই কোনো প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন করেনি। বর্ষা আসলে কেবল জোড়াতালি দিয়েই সময়টা পার করে। ফলে সরকারি বরাদ্দের কোনো সুফল মেলে না। তবে সম্প্রতি পেকুয়া উপজেলার মগনামায় শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাঁটি ঘিরে ওই এলাকায় সাগর উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মিত হয়েছে। উপকূল এলাকা জুড়ে এ ধরনের বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন চান চকরিয়া-পেকুয়া এলাকার বাসিন্দারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, ঘূর্ণীঝড় পরবর্তী উপকূল এখন পুরোপুরি সুরক্ষিত তা আমি বলব না। তবে সেই ঘূর্ণিঝড়ের পর এখন উপকূলের বেড়িবাঁধের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মাতারবাড়ীতে টেকসই অর্থাৎ একশ বছর মেয়াদি বেড়িবাঁধ নির্মাণে আমরা জাপানি সহায়তা চাইছি। আর কুতুবদিয়া দ্বীপের বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারি অর্থায়নে করার পরিকল্পনা নিচ্ছি। এ ছাড়া চকরিয়া যেই গুরুত্বপূর্ণ অংশে ঝুঁকি আছে সেগুলো বিদেশি কোনো অর্থায়নে বড় প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি। কারণ এতটাকা সরকারি অর্থায়নে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। এরই অংশ হিসেবে মাতামুহুরী নদী শাসনটা জাপানের জাইকাকে দিয়ে এবং মাতামুহুরী নদীতে দুটি রাবারড্যাম সংস্কার সরকারি অর্থায়নে করতে চাইছি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় সমুদ্র উপকূল, নদীতীরের প্রায় ২৮৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। তন্মধ্যে চকরিয়ায় রয়েছে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার এবং পেকুয়ায় ২৪০ কিলোমিটার। এই বেড়িবাঁধের মধ্যে চকরিয়ার প্রায় ৩৬ কিলোমিটার অংশ ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। সেই ভঙ্গুর বেড়িবাঁধ এবং নদী ভাঙনের কবল থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার পর্যন্ত তীর টেকসইভাবে সংরক্ষণের জন্য ব্লক বসানো, ১৬টি নতুন স্লুইস গেট স্থাপন করা, পুরাতন ২৭টি স্লুইস গেট রিপেয়ারিং করার জন্য প্রকল্প প্রস্তাব ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। চকরিয়া অংশের এসব কাজ বাস্তায়নের জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯২২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
Discussion about this post