চট্টগ্রাম, ২ জুলাই, ২০২৩:
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিশ্চিত না করে দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা একের পর এক বাড়ছে। যেখানে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও গুণাবলী সম্পন্ন অভিজ্ঞ শিক্ষকের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিম্নগামী হচ্ছে। যেখানে গবেষণার সুযোগের অভাব, প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতি, স্থায়ী ক্যাম্পাসও নে্ই অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এজন্য সরকারের নীতি এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদগণ।
বর্তমানে, দেশে ৫৪ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যার মধ্যে ৫০টি একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। সম্প্রতি আরও তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। মন্ত্রিসভা ১৯ জুন ‘লক্ষ্মীপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল, ২০২৩’ চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় এবং ‘ঠাকুরগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় বিল, ২০২৩’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শরীয়তপুর বিল, ২০২৩’-এর খসড়া অনুমোদন দেয় ‘ ১২ জুন।
অন্যদিকে দেশে এখন ১১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যার মধ্যে ১০২টি একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। গত জুন মাসে কুষ্টিয়ায় লালন বিজ্ঞান ও কলা বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয় ইউজিসি। পরিসংখ্যান মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, আগের দশকগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে।
বিপরীতে, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মাত্র তিন বছরে সাতটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে, সর্বোচ্চ ৫১টি ২০১০-এর দশকে স্থাপিত হয়েছিল, তারপর ২০০০-এর দশকে ৩৮টি এবং ১৯৯০-এর দশকে ১৫টি স্থাপিত হয়েছিল। ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পাঁচটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, পাবলিক ও প্রাইভেট উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি হলেও দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান না বেড়ে বরং নিম্নগামি হচ্ছে। পর্যাপ্ত শিক্ষক এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মাত্র কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করছে এবং গবেষণার সুযোগ কমছে।
তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত অনুষদ, ল্যাবরেটরিসহ ভৌত সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে এবং ক্যাম্পাসের জায়গার অভাবে এগুলো অবস্থান নির্ধারণ করতে বেগ পেতে হয়। রাতারাতি যোগ্য ও অভিজ্ঞ অধ্যাপক তৈরি করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে নজরুল ইসলাম বলেন, কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর ছাড়াই চলছে, যা একেবারেই হতে দেওয়া উচিত নয়। এছাড়া অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস, উপাচার্য ও পর্যাপ্ত তহবিল নেই। তিনি উল্লেখ করে বলেন, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক তাদের বেশির ভাগই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বা সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। প্রাক্তন ইউজিসি চেয়ারম্যান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নবনির্মিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ মালিক কোনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাও করেননি, ‘কিন্তু তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক’।
তিনি বলেন, সরকারের নীতিই মূলত এ অবস্থার জন্য দায়ী। তিনি বলেন, সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে। সরকার কঠোর হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেও জানান নজরুল।
ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় রাতারাতি গড়ে উঠতে পারে না। সরকার প্রতি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় করার নীতি গ্রহণ করেছে।
ইউজিসি ওয়েবসাইট অনুসারে, এখন পর্যন্ত, তিনটি নতুন ব্যতীত আটটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ক্যাম্পাস নেই যখন নতুনটি বাদে ৬৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাস ছাড়াই রয়েছে।
উপাচার্য ছাড়াই চলছে ৩৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
ইউজিসির ৪৮তম বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সাল থেকে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। ২০১৮ সালে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩.৬১ লাখ, যা ২০১৯ সালে ৩.৪৯ লাখ, ২০২০ সালে ৩.২৮ লাখ এবং ২০২১ সালে ৩.১০ লাখে নেমে এসেছে। এই সময়ের মধ্যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০১৮ সালে ৪০.৪৯ লাখ ছিল, যা ২০১৯ সালে ৪০,৮৫ লাখে কমেছে, ২০২০ সালে বেড়ে ৪৩.৬২লাখ হয়েছে কিন্তু ২০২১ সালে আবার ৪১.৩১ লাখে নেমে এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান উল্লেখ করেন, অনেক দেশের অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য গেছেন। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির এখনও উচ্চ চাহিদা রয়েছে এবং বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এই ধরনের ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিদেশে যাচ্ছেন।
প্রফেসর তারিক বলেন, সরকার যখন টাকা জমা রাখতে দেশে আরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে, সে কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনি পরামর্শ দেন, প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে এবং কারিগরি শিক্ষাকে ব্যাপকতর করা এবং আরও বেশি শিক্ষার্থীকে সেই শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করা।
অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ অব বাংলাদেশের সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ‘আমি জানি না আমরা সেটা করতে কতটা সফল হয়েছি, মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকার যখন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন করছে তখন তাদের চাহিদা ছিল। তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে অভিজ্ঞ ও যোগ্য শিক্ষকের সংকট রয়েছে। তবে এখন আমরা প্রয়োজনীয় শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করছি,’ তিনি যোগ করেন।
দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের একজন সিনিয়র নেতা বলেন, উন্নত দেশগুলোতে কেউ পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষককতা করতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। তিনি প্রশ্ন করেন, পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষকের শিক্ষা কি একই হতে পারে?
ইউজিসি সদস্য প্রফেসর বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যত বাড়ছে শুধু যোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়ই দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে। তিনি বলেন, এটা সত্যি যে দেশে এখন মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সংকট, কিন্তু এই সমস্যা সাধারণত যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতেই থাকে। যখন একটি বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক বছর চলে তখন এই সংকট লাঘব হয়। রিপোর্টটি NEW AGE পত্রিকা থেকে নেয়া।
Discussion about this post