চট্টগ্রাম, ৮ আগস্ট, ২০২৩:
টানা চারদিনের বর্ষণে চট্টগ্রাম নগরীতে বিপর্যয় নেমে আসার কারণ অনুসন্ধান করে সভা করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও সেবা সংস্থাগুলো।। একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। সমন্বয়হীনতার কথা বলেছে। আবার সমন্বয় করার কথাও উঠে এসেছে।
চট্টগ্রামে টানা চারদিন অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় কার্যত অচল হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম নগরী। পানিবন্দি ছিলেন নগরবাসী। ছিল পাহাড় ধসের মত আতঙ্ক। গত এক সপ্তাহে চট্টগ্রামে ৬৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
জানা গেছে, মঙ্গলবার বিকালে টাইগারপাস্থ চসিক কার্যালয়ে আয়োজিত সভায় একাধিক কাউন্সিলর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) দ্রুততম সময়ে জলাবদ্ধতা প্রকল্প শেষ করতে তাগিদ দেয়ার জন্য সিটি মেয়রের কাছে আবেদন জানান।
আজ দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৭তম সভায় পাহাড়ে অবৈধ বসতি স্থাপনের জন্য এক সংস্থা আরেক সংস্থাকে দোষারোপ করেছে।
চসিকের সভায় কাউন্সিলররা সিডিএ’র জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত না করায় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প জনস্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন।
তবে পাহাড় রক্ষা কমিটির সভায় চসিককে অভিযুক্ত করেছে রেলওয়ে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম শহরে রেলওয়ের অনেকগুলো পাহাড় আছে। সেখানে অবৈধ দখলদার আছে এটিও সত্যি। ফয়েজলেকে ১,২,৩ নং ঝিলে ৪৪৭৬টি পরিবার অবৈধভাবে দখলে আছে। তা নিয়ে ৩-৪টি মামলাও আছে। এতবড় জায়গা আমাদের পক্ষে ঘেরাবেড়া দেয়া যায় কিনা সেটি প্রকৌশল বিভাগ দেখবে।
সরকারি-বেসরকারিভাবে সেখানে রাস্তা ড্রেন নির্মিত হচ্ছে। এমনকি বিদেশী অর্থায়নও হচ্ছে। সুবিধা দিলে অবৈধ দখলদার উৎখাত করা কঠিন হবে। চসিক আনুষ্ঠানিক অনুমতি না নিয়ে ফয়েজলেকে বিদেশী এনে বস্তিবাসীর উন্নয়নে প্রকল্প নিচ্ছে। এ নিয়ে গত ২১জুন চসিককে চিঠিও দিয়েছি। বাটালি হিলে পাদদেশে সেখানে রাস্তা করে দেয়া হয়েছে। ওয়াটার সিস্টেম, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদেশী অর্থায়নে সরকারের সহায়তায় ১৪নং ওয়ার্ডে ড্রেনসহ ৭৫ সিসি সড়ক করা হচ্ছে।
চসিকের প্রধান নির্বাহী শেখ মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ফয়েজলেকে আমাদের কিছু ফ্যাসিলিটির কাজ হয়েছে। যা বেশ কয়েক বছর আগের প্রকল্প। সেখানে আমাদের ইউএনডিপির প্রকল্প আছে। এ প্রকল্পে ২০ কোটি টাকা ফান্ড আছে। আমরা ২০ কাটার একটি জায়গা সিলেক্ট করেছি। সেখানে হাইরেজ ভবন হবে। যেখানে বস্তিতে থাকা লোকদের বাসস্তানের সুযোগ করা হবে।
চসিকের প্রধান নির্বাহীর বক্তব্যের জবাবে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ২০ কাটা জায়গায় কতগুলো পরিবারকে পুনর্বাসন করা সম্ভব। যাই করেন ভূমির মূল মালিক রেলওয়ের সাথে পরামর্শ না করে করা উচিত না। এটা শুধু রেলের ভূমির বিষয় না, যেসব সংস্থার জায়গা আছে তাদের সাথে কথা বলে এসব করতে হবে।
চট্টগ্রাম সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী চসিকের সভায় বলেছেন, রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি, ঢলের পানি, জোয়ার আর অসমাপ্ত প্রকল্প-সব মিলিয়ে চট্টগ্রামতো বটেই বান্দরবান আর সাতকানিয়ার মতো এলাকায়ও পানি উঠেছে। তিনি চসিক প্রকৌশল বিভাগকে বিদ্যমান অবস্থায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার আরো উন্নয়নে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা তৈরির নির্দেশনা প্রদান করেন।
তাদের সভায় প্রবল বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের বিবরণ এবং তা সংস্কারের কৌশল তুলে ধরে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক।
মেয়রের একান্ত সচিব মুহাম্মদ আবুল হাশেম উপস্থিত সকল কাউন্সিলরকে এলাকায় ড্রেনে কোন প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা দেখার ও দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করার উপর গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য রাখেন। তিনি দ্রুত রাস্তায় সৃষ্ট গর্তগুলো ভরাট করে জন ও যান চলাচল নির্বিঘ্ন করার জন্য প্রকৌশল বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সভায় কাউন্সিলরবৃন্দও উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে সার্কিট হাউজে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় চট্টগ্রামের পাহাড় অবৈধ দখলদারদের দেয়া বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস লাইন বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জোরোলো আলোচনা হয়েছে।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. তোফায়েল ইসলাম বলেছেন, পাহাড়ে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ ও পাহাড় কর্তন বন্ধে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, রেলওয়ে ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে মিলে সেটেলমেন্ট করতে হবে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, দখলদাররা পাহাড়ে বস্তি বানিয়ে রেখেছে। উচ্ছেদ করলেও ঘেরাবেড়া না দেয়ায় আবারও পাহাড় দখল হচ্ছে। সরকারি সংস্থার জায়গাগুলো নিজেরা ঘেরাবেড়া না দিলে প্রতিনিয়ত দখল হবে। উচ্ছেদ করলেও পুনরায় দখল যাতে না হয় সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, ‘ত্রিপক্ষিয় মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে হবে। কাজ শুরুর পর অনেকদূর গেলেই পরে জানানো হয় তখন কিছুই করার থাকে না।’ জবাবে বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘পরিবেশেরও দায়িত্ব আছে। যার যার দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হবে।’
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক বলেন, ‘পরিবেশের মামলার সংখ্যা বাড়তে দেখেছি। কিন্তু জেল, জরিমানা করা হয় না।
জবাবে পরিবেশ পরিচালক বলেন, আমাদের মামলার অনেক আসামি। সবাই জামিন নিয়ে চলে আসেন।
অবৈধ দখলদারদের বিদ্যুৎ লাইন দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে সকল সরকারি জায়গা দখলে থাকে সেখানে বিদ্যুৎ লাইন পায় কিভাবে? অন্যান্য সুবিধা কিভাবে পায়। একবার কেউ সুবিধা পেলে মানবিক ও আইনগত বিষয় থাকে।
বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘সরকারি জায়গা কে ভাড়া দিল, কার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে সেগুলো তালিকা করে দেন।’ এসময় রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখলে রেখে জায়গা ভাড়া দিচ্ছে। বিভাগীয় কমিশনার বলেন, ‘এটি কমিটি সরকারের পক্ষের কমিটি। সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতা কারোও নেই। এখানে বলতে না পারলে তিন সংস্থা (চসিক, রেল ও পরিবেশ) মিলে তালিকা দেন। নতুন করে কেউ বিদ্যুৎ সংযোগ পাবে না।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ বলেন, উচ্ছেদ করতে গেলে ভাড়াটিয়ার সাথে জনপ্রতিনিধিও আসে। তখন মনে হয় এক হাজার লোক। প্রকৃতপক্ষে ভাড়াটিয়া এক হাজার না। প্রতিবছর ১০শতাংশ করে দখলদার বাড়ছে। এরা বৃক্ষ নিধন, পাহাড় কর্তন করছে। পাহাড় এখন রক্ষা না করলে পরে পারা যাবে না। রেলওয়ে এসব গ্রুপকে ক্ষেপাতে চায় না। তারা হয়তো মনে করে কয়েক বছরের জন্য বদলি হয়ে এসেছি আবার চলে যাবো, তাদের ক্ষেপিয়ে লাভ নাই। সেখানে দখলদাররা লাখ লাখ টাকা ভাড়া পাচ্ছে। শুধুই পাহাড় দখল না, মাদকের আগ্রাসন বাড়ছে।