চট্টগ্রাম, ২৩ অক্টোবর, ২০২৩:
মান্তা হচ্ছে তারা যাদের জন্ম, জীবন-জীবিকা, মৃত্যু সবটাই নৌকায়, নদীতে কিংবা সাগরে ভেসে ভেসে। মৃত্যুর পর কেবল লাশ দাফন করা হয় ডাঙ্গায়। এক অদ্ভুত জীবন তাদের। মান্তারা বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের নাগরিক।
মান্তা নামে একটি সামুদ্রিক প্রাণিও আছে। এসব মান্তা পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় সমস্ত প্রধান মহাসাগরীয় জলে বিচরণ করে এবং এদেরকে উষ্ণমণ্ডলীয় সমুদ্রগুলিতেও বিচরণ করতে দেখা যায়। কিছুটা গোলাকৃতির মান্তা ২৩ থেকে ১৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ মান্তারা কেন জলেই জীবন কাটিয়ে দেয়। সেখানে তাদের জন্মমৃত্যু। মান্তারা অনেকে কয়েক পুরুষ ধরে নৌকাতেই। জানে না তাদের স্থলের ঠিকানা। কিন্তু ডাঙায় তাদের সবই ছিল। হয়ত এক পুরুষ কিংবা কয়েক পুরুষ আগে। কিন্তু অনেকেই জানে না তাদের পিতা-পিতামহের ডাঙায় ঘরবাড়ি ছিল।
যারা নদী তীরবর্তী সাগর সংলগ্ন বসবাসকারী মানুষ ছিল, ঘরবাড়ি ছিল নদীর কাছে। তারা একদিন নদীভাঙ্গনের কবলে পড়ে সেই যে নৌকায় বসতি পাতে, ঘর-গেরস্থালী সব- নৌকায় ভাসতে ভাসতে। তারপর তাদের আর ডাঙায় ফেরা হয় না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। একটি ছোট নৌকাই সম্বল। সাথে মাছ ধরার জাল সরঞ্জামপাতি। সারাদিন মাছ ধরা, বিক্রি আর নৌকাতে সংসার, জীবন, সন্তানসন্ততির জন্মদান সবই নৌকায়, সেখানে বসবাস। ঠিকানা বলতে শুধুই ছাউনি ঘেরা নৌকাটি।
সারাদেশে সবমিলে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মান্তার একটা আনুমানিক হিসাব পাওয়া যায়। ভোলার তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন, দৌলতখানসহ সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। অনেকে থাকেন পটুয়াখালীর গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, চরমোন্তাজ, বরিশালের মুলাদি, মেহেন্দিগঞ্জ, বানারীপাড়াসহ সদর উপজেলায়। তা ছাড়া লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীরহাট, রায়পুরের নাইয়াপাড়া, কমলনগরের মতিরহাট, রামগতি, চর আলেকজান্ডার, সন্দ্বীপ, হাতিয়া সহ বিভিন্ন এলাকায়। বাংলাদেশের নাগরিক হলেও এদের বেশিরভাগের নেই জাতীয় পরিচয়পত্র। সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির ভাতাও তারা পায় না বলে জানা যাচ্ছে। ভালো জীবন, ভালো পোশাকপরিচ্ছদ, শিক্ষার আলো তাদের কাছে বিলাসিতা, যদিও গুটিকয়েক মান্তা শিশুরা পড়ালেখা শিখছে বলে জানা যাচ্ছে, যা কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। আর গুটিকয়েক মান্তারা ভোটাধিকারের সুযোগ ও সরকারি কিছু সহায়তা পাচ্ছেন।
আর সম্প্রতি মান্তাদের জন্য সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ঘর করে দেওয়ার কথাও শুনা যাচ্ছে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজ ইউনিয়নে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় মুজিববর্ষ উপলক্ষে নদীতে নৌকায় ভেসে বেড়ানো মান্তা সম্প্রদায়ের ৫৯ পরিবারকে ঘর দেওয়ার খবর পত্রপত্রিকায় এসেছে। তবে মান্তারা যাদের জন্য সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়া হচ্ছে তা কর্মস্থল থেকে অনেক দূরে হওয়ায় তাদের বসবাস সহজও হচ্ছে না ক্ষেত্রবিশেষে।
তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী উদ্যোগ-আশ্রয়ণ প্রকল্পে পটুয়াখালীর চর মোন্তাজের মান্তাদের মত দেশের সব মান্তাদের ঘর দেওয়ার আহ্বান মান্তা সম্প্রদায়ের মানুষের। সারাদেশে তারা- মান্তারা সবাই যেন জাতীয় পরিচয় পত্র পেয়ে সকল নাগরিক সুযোগসুবিধার আওতায় আসে -সেটাও মান্তার অগ্রসর জনদের দাবি।
আশ্রয়ের সাথে সাথে জীবন-জীবিকাও যেন তাদের নিশ্চিত হয়। মান্তাদের সেই ‘নৌকা ভাসান’র জীবনের যেন অবসান হয়। যাদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ।
Discussion about this post