চট্টগ্রাম, ০ে৯ নভেম্বর, ২০২৩:
কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ আগামী শনিবার থেকে শুরু হবে। আগামী ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের চ্যানেল উদ্বোধন এবং মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। উদ্বোধনের পর থেকে শুরু হবে টার্মিনাল নির্মাণের কাজ।৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের ও সাড়ে ১৮ মিটার ড্রাফটের (গভীরতা) দুটি পণ্যবাহী জাহাজ একসঙ্গে ভিড়তে পারবে।
কর্ণফুলী নদীর গভীরতা কম হওয়ায় দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে মাদার ভেসেলগুলো ভিড়তে পারে না। চট্টগ্রাম বন্দরে এখন ভিড়তে পারে সর্বোচ্চ ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ। বহিঃনোঙ্গর থেকে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে পণ্য কিছুটা খালাস করে মূল জেটিতে নোঙর করার পর তারপর মালামাল খালাস করে।
অন্যদিকে গভীর সমুদ্র থেকে অথবা শ্রীলঙ্কা বা সিংগাপুর পোর্ট থেকে ফিডার ভেসেলে পণ্য আনা নেওয়ার মাধ্যমেই ইম্পোর্ট এক্সপোর্ট কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে এভাবে পণ্য আনা নেওয়া করাতে বাড়তি সময় লাগার পাশাপাশি বেড়ে যায় খরচও।
এতে দেশের প্রধান সমুদ্র চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের পরিমাণ প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম বন্দরের উপর কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের চাপ কমাতে এবং কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংর খরচ কমিয়ে এক্সপোর্ট-ইম্পোর্টকে বুস্ট করতে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ শেষ হলে ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের ও সাড়ে ১৮ মিটার ড্রাফটের (গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারলে দেশেরি বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপট বদলে যাবে।কারণ দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো বন্দরে নেই এতটা গভীরতা। এত বড় জাহাজ নোঙর করার সক্ষমতাও নেই অন্য কোনোখানে। ফলে মাতারবাড়ী ঘিরে এ অঞ্চলে গড়ে উঠবে আঞ্চলিক বাণিজ্যের হাব।
এ ব্যাপারে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে জানান, আমরা ২০২৬ সালে মাতারবাড়ী বন্দরের কার্যক্রম শুরু করতে চাই। বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজনীয়তা আছে। প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে পুরোদমে শুরু হবে মূল কাজ। মাতারবাড়ী আঞ্চলিক বন্দর অন্য দেশও ব্যবহার করতে পারবে। এটি পুরো দেশের অর্থনীতিতে গতি আনবে। মাতারবাড়ীতে বন্দর করতে যে বিনিয়োগ করা হবে, তা সাত থেকে আট বছরের মধ্যে ফেরত আসবে বলে জানান নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এখন চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিবছর ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা লাভ করে। মাতারবাড়ী বন্দর অবকাঠামো নির্মাণে ৯ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হবে। সেটি সাত-আট বছরের মধ্যে উঠে আসবে। প্রতিবছর ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আয় হবে।
ব্যবসায়িদের অভিমত, ২০২৬ সালে মাতাবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করা সম্ভব হলে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে বড় পরিবর্তন আসবে।এতে পন্য আমদানি রপ্তানির ব্যয় কমে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, মাতারবাড়ী চালু হলে জাহাজ ভাড়া তিন ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে। এখান থেকে পায়রা, চট্টগ্রাম ও মোংলায় আঞ্চলিক বন্দরগুলোতে নতুন নৌরুট তৈরি হবে। যে পণ্যের জন্য আগে তিন হাজার ডলার ভাড়া লাগত, মাতারবাড়ী হলে তা এক হাজারে নেমে যাবে। এখন থেকে প্রতিবছর অর্থ আমাদের রিজার্ভেও যুক্ত হবে। তখন কোথাও আমাদের ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ দিতে হবে না।
২০১৮ সালে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটার মাতারবাড়িতে জাইকার সহায়তায় মাতারবাড়ি কোলফায়ার পাওয়ার প্লান্টের কাজ শুরু হয়। কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্লান্ট হওয়ায় সেখানে কয়লা আনার জন্য একটি জেটি নির্মাণের জন্য জাইকার ফিজিবিলিটি স্টাডির রিপোর্টে দেখা যায় যে মাতারবাড়ির ওই এলাকায় সমুদ্রের গভীরতা ১৫.৫ মিটার এবং কিছুদূর এগোলেই গভীরতা ৩০ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যায়। যা একটি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য আদর্শ।
মূলত সেখান থেকেই দেশের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য মাতারবাড়িকে সাজেস্ট করে জাইকা। এর আগে অবশ্য গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য চীনের পরামর্শ অনুযায়ী সোনাদিয়া দ্বীপকে চিন্তা করা হলেও পরবর্তীতে পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু সেখানেও চ্যানেলের ৭০ কি.মি. এলাকায় ড্রেজিং করতে প্রতি বছর প্রচুর টাকা খরচ হবে বিধায় প্রকল্পটি আটকে ছিলো। মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের চলমান মেঘা প্রজেক্টগুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রজেক্ট।
জাইকার অর্থায়নে ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে জাইকা ১২ হাজার ৮৯২ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার ২ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে কোনো পণ্যষ এক্সপোর্ট বা দেশি পণ্য ইম্পোর্ট করার জন্য ভারত, শ্রীলঙ্কা বা সিংগাপুরের ডিপ সী পোর্ট ব্যবহার করে। কেননা বাংলাদেশে কোনো ডিপ সী পোর্ট না থাকায় কোনো মাদার ভেসেলগুলো সমুদ্র বন্দর গুলোতে প্রবেশ করতে পারে না। যার কারণে এক্সপোর্টের জন্য দেশের বন্দরগুলোতে ফিডার ভেসেলে করে পণ্যবাহী কার্গোগুলো প্রথমে উক্ত দেশের পোর্টে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে মাদারভেসেলে তা লোড করতে হয়। এবং ফিডার ভেসেলগুলো ফিরার পথে ইম্পোর্টারদের কার্গো নিয়ে ফিরে আসে। দূরত্বের কারণে এক্সপোর্ট বা ইম্পোটের জন্য এই বন্দরগুলো থেকে পণ্য পরিবহনের খরচ ও সময় অনেক বেশি বেড়ে যায়। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর অপারেশনাল হওয়ার পরে যেহেতু মাদার ভেসেলগুলো এই বন্দর এসে ভিড়তে পারবে তাই সমুদ্র পথে সামগ্রিক পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে প্রায় ১৫ শতাংশ। খরচের সাথে যেহেতু সময় ও কমবে তাই দেশের এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ম্যানুফ্যাকচারাররাও এর সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছাড়াও আরো বেশ কিছু পরোক্ষ প্রভাবও রয়েছে।
মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরত্বে ধলঘাটায় ৩৫০০ একর জমিতে ইতোমধ্যেই মহেশখালী ইকোনমিক জোন তৈরি হচ্ছে। এই ইকোনমিক জোনটি অপারেশনাল হলে অনেক দেশী-বিদেশী কোম্পানি এখানে তাদের প্রডাকশন ও ম্যানুফ্যাকচারিং বিজনেস এস্টাব্লিশ করবে। যার কারণে সৃষ্টি হবে প্রচুর পরিমাণে নতুন কর্মসংস্থানের। এছাড়া মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরের এতো কাছে হওয়াতে মহেশখালী ইকোনমিক জোনের প্রডাকশন বা ম্যানুফ্যাকচারিং রিলেটেড কাঁচামাল সহজে আমদানি করা সহজ হবে। আবার এই ইকোনমিক জোনে প্রস্তুতকৃত পণ্য গুলো মাতারবাড়ি পোর্ট ব্যবহার করে দেশের অন্যান্য এলাকায় ট্রান্সফার করা থেকে শুরু করে বিদেশেও সরাসরি এক্সপোর্ট করা সম্ভব হবে। যা পণ্য পরিবহন ও এক্সপোর্ট এর সময় অনেকাংশে কমিয়ে আনবে।
এছাড়া এই সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাবে ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, ভূটান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও চীনের মত প্রতিবেশী দেশগুলো।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে আলোচনা ‘টুওয়ার্ড ইমপ্রুভিং রিজিওনাল কানেক্টিভিটি অ্যান্ড রিয়েলাইজিং দ্য এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভ্যালু চেইনস ইন বে অব বেঙ্গল রিজিয়ন, ইনক্লুডিং বাংলাদেশ অ্যান্ড নর্থইস্ট ইন্ডিয়া’ সেমিনারে ‘মাতারবাড়ী ইকোনমিক হাব: প্রসপেক্ট অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক নিবন্ধে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচায্য বলেছেন, কক্সবাজারের মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর ও আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রকল্প দুটি কেবল দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে না ইন্দো প্যা সিফিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব রাখবে। সেখানে বলা হয়, *দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সেতুবন্ধে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কেন্দ্র করে কৌশলগত অবস্থান মাতারবাড়ীর রয়েছে। এছাড়া * মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর হবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি পণ্য রফতানির করিডোর, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর দিয়ে রফতানির সময় ৪৫ থেকে ২৩ দিনে নেমে আসবে, চীন ও জাপানের বিনিয়োগ সরে আসার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ ইকোনমিক করিডোরে সংযুক্ত হতে পারবে মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দর।
Discussion about this post