চট্টগ্রাম, ২৬ জানুয়ারি,২০২৪:
২০২৩ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন লেখক, সাহিত্যিক, কবি ও গবেষক সহ ১১ জন। এই ১১ ক্যাটাগরিতে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নিয়ে চলছে বিভিন্ন আলোচনা। কেউ কেউ সমালোচনাও করছেন বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্তদের বাছাই নিয়ে। এই আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষিতে ফেসবুকে লিখেছেন বিডিনিউজে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিক ও সাহিত্যিক রাজীব নূর। সেই লেখাটি পিসিএল পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:
-আপনার জানা নেই বলে, আপনি পড়েননি বলে কেউ পুরস্কার পেতে পারবেন না— এমনটা ভাববার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। কারোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার আগে একটু খোঁজখবর করতে সমস্যাটা কই?
বলে রাখা ভালো পুরস্কার-টুরস্কার নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, বিশেষ করে সাহিত্য পুরস্কার নিয়ে, যেমন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, যেখানে প্রতিযোগিতা করার দরকার পড়ে না এবং পুরস্কার দেওয়ার প্রক্রিয়াটাও অস্বচ্ছ। কোনো নির্দিষ্ট বই নয়, সামগ্রিক সাহিত্য কীর্তির জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়। ফলে মাঝারি মানের লেখকরাও ‘সামগ্রিক কীর্তি’র জন্য পুরস্কার পেয়ে যান।
পুরস্কারের জন্য একাডেমির ৩০ জন ফেলোর কাছে প্রথমে নাম চাওয়া হয়। এই ফেলোদের কারা নির্বাচন করেন, বলা হয়ে থাকে, একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদ করে। পরিষদটা কি সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হয়? এই তো সেদিন আমার এক সহকর্মী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে একটা রিপোর্ট করলেন— “স্বায়ত্তশাসিত কি অধীনস্থ? সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ‘দাদাগিরিতে’ ক্ষোভ।” সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবদার বাংলা একাডেমিসহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের নিচে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় লিখতে হবে। নাম লেখা না হলেও নিয়ন্ত্রক যে মন্ত্রণালয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
যাই হোক, ৩০ জন ফেলোর পাঠানো নামগুলো নীতিমালা অনুযায়ী নিয়ে যাওয়া হয় বিচারকদের কাছে। ফেলোদের পাঠানো নামের বাইরে থেকে পুরস্কার দেওয়ার এমন অনেক গল্প জানি আমি। বিচারকরা যদি মনে করেন, অমুক পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য, তবে তমুককেও সঙ্গে পুরস্কার দিতে হবে, তমুকের জন্য জোর তদবির আছে, তবে তমুককেও সেটা দিয়ে দিতে পারেন। দেনও প্রায়শই। কার ইচ্ছেতে দেন? মহাপরিচালকের? মহাপরিচালককে নিয়োগ দেন কারা? ওই ‘কারা’দের ইচ্ছেতে এবারও অমুকের সঙ্গে তমুককে জুড়ে দিয়ে ১১টি ক্যাটাগরিতে ১৬ জনকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। এ নিয়ে বরাবরই যথেষ্ট তর্ক-বিতর্ক হয়। সোশাল মিডিয়া আজকাল এই তর্কাতর্কিটা বেশ সহজ করে দিয়েছে।
নেটনাগরিকরা গত বছর তর্ক জুড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত মুহাম্মদ শামসুল হককে নিয়ে। অথচ এই ভদ্রলোক নিরলসভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করে চলেছেন বহুদিন ধরে। থাকেন চট্টগ্রামে। বিদ্বজ্জনের সমাজে পাত পাততে আসেন না বলেই আক্রান্ত হয়েছিলেন। এবার আক্রমণের শিকার হচ্ছেন কথাসাহিত্যের জন্য পুরস্কৃত নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর।
আমার বন্ধুদের একজন ফেইসবুকে লিখেছেন, “কথাসাহিত্যিক হিসেবে নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর নামটা আজকে দেখলাম তার কোনো বইয়ের নাম জানেন কেউ? ভদ্রলোক বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাইছে।” অন্যজনের বক্তব্য অবশ্য বেশ মার্জিত, “অজ্ঞতা মার্জনা করবেন। কথাসাহিত্যিক হিসেবে নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর নামটা একেবারেই অপরিচত। কেউ কি পড়েছেন? একটু আলোকপাত করবেন?” আরেক বন্ধু আমাকেই ফোন করে জানতে চাইলেন, আমি নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর সম্পর্কে জানি কিনা, তাঁর বই-টই পড়েছি কিনা?
আরও কারো কারো এমন লেখা দেখলাম গত দুদিন ধরে, নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরকে নিয়েই মূলত। আমার বন্ধুত্রয়কে উদ্ধৃত করছি এ কারণে যে, তাঁদের একজন কবি, একজন প্রকাশক, অন্যজন সাংবাদিক। ব্যক্তিগতভাবে আমি জানি, তাঁরা পড়াশোনা করেন। বইপত্রের খোঁজখবরও রাখেন। তাই বলে সব বই তাঁদের পড়া হয়ে যাবে, কোনো নিভৃতচারী লেখক তাঁদের অচেনা থাকবে না, ব্যাপারটা তো মোটেই এমন নয়।
ধরুন আমি নিজেও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গবেষণায় পুরস্কারপ্রাপ্ত দুজন, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল ও মজিবুর রহমানের মধ্যে মজিবুর রহমানকে চিনিই না। গুগল সার্চও আমাকে এই গবেষক সম্পর্কে কোনো সহায়তা দিতে পারল না। নিশ্চয়ই আরও খোঁজখবর করব এই গবেষক সম্পর্কে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় পুরস্কারপ্রাপ্ত দুজনের মধ্যে আসাদুজ্জামান আসাদের কিছু কাজের সঙ্গে পরিচয় থাকলেও আফরোজা পারভীনের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো লেখা আগে পড়িনি। গুগল অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা তাঁর দুয়েকটি বইয়ের নাম জানাল এখন, যেগুলো আমার পড়া হয়নি। ‘রক্তবীজ’ নামে একটি ওয়েব পোর্টালে তাঁর লেখা যুদ্ধদিনের একটা ছোট্ট স্মৃতিচারণ পড়লামও, এটুকুন পড়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
গত কয়েক বছরের মধ্যে এবারই বোধ হয় পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকাটা সবচেয়ে ভালো হয়েছে বলে মনে করি আমি। শামীম আজাদ কবিতার জন্য পুরস্কৃত হচ্ছেন জেনে ভাবলাম ভুল শুনছি না তো। তিনি কি বাংলা একাডেমি পাননি? তাঁকে আরও আগেই পুরস্কার দেওয়া যেত।
আমি প্রতিবারই অপেক্ষা করি ময়ূখ চৌধুরী পুরস্কৃত হয়েছেন— এই খবরটা শোনার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জয়দুল হোসেন পুরস্কার পেয়েছেন জানলে ভালো লাগবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তিনি তুলে এনেছেন। ময়ূখ স্যার আমার শিক্ষক, জয়দুল ভাই গুরু। তাঁদের যথেষ্ট বয়স হয়েছে এবং প্রয়াতকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেওয়ার নিয়ম নেই। ময়ূখ চৌধুরীকে পুরস্কার দিতে না পারা বাংলা একাডেমির আরও সব কলঙ্কের একটি হয়ে থাকবে।
জুলফিকার মতিন ও ইসহাক খান পুরস্কার পেতেই পারেন। আমি খুব খুশি হয়েছি ইনাম আল হক পুরস্কার পাওয়ায়। সবচেয়ে আনন্দের যে এবার একজন আদিবাসীকে পুরস্কৃত করছে বাংলা একাডেমি— তিনি মৃত্তিকা চাকমা। পুরস্কার পাচ্ছেন নাটক ও নাট্য সাহিত্যে। চাকমা ভাষায় বেশ কিছু নাটক আছে মৃত্তিকা দাদার। বাংলায়ও লিখেছেন কিছু। বাংলা একাডেমি বুঝেশুনে না করলেও বাংলাদেশে যে বাংলা ছাড়া আরও অনেক ভাষা আছে, সেই সব ভাষায় সাহিত্য রচিত হচ্ছে, মৃত্তিকা চাকমার পুরস্কারে তার স্বীকৃতি মিলল।
আমার স্মৃতি প্রতারণা না করলে এতকাল এ পুরস্কারটি শুধু নাটক ও নাট্যসাহিত্য নামেই পরিচিত ছিল, এবার এর সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দি করে (যাত্রা/পালা নাটক/সাহিত্যনির্ভর আর্টফিল্ম বা নান্দনিক চলচ্চিত্র) করা হয়েছে এবং মৃত্তিকা চাকমার সঙ্গে এই পুরস্কারটি শেয়ার করছেন চলচ্চিত্র পরিচালক মাসুদ পথিক। সাহিত্যনির্ভর আর্টফিল্ম বা নান্দনিক চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো পুরস্কৃত হয়ে মাসুদ পথিক ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন। শেখ নিয়ামত আলী না হয় বেঁচে নেই, মসিহউদ্দিন শাকের ও তানভীর মোকাম্মেলরা তো মরে যাননি।
অমুকের সঙ্গে তমুককে খুশি রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গবেষণার মতো ফোকলোরে দুজনকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, পুরস্কৃতরা হলেন তপন বাগচী ও সুমনকুমার দাশ, দুজনই আমার ঘনিষ্ঠজন। সুমনের পুরস্কারপ্রাপ্তি আমাকে উচ্ছ্বসিত করেছে, নিবিড় গবেষক আমার এই ভাই-বন্ধুটি। তপন বাগচীকে যদি পুরস্কার দিতেই হয়, আসছে বার সুমনকুমার দাশকে দিলে ক্ষতি কী হতো?
এই পুরস্কার কোনো প্রতিযোগিতা নয়, আগেই বলেছি। বিচারকরা তো গোপনে নাম্বার দেন না যে দুজন প্রতিযোগী সমান নাম্বার পেয়ে গেলেন। আর প্রতিযোগিতা হলে আমার ধারণা সুমনের চেয়ে কম নাম্বার পেতেন তপনদা।
কথাসাহিত্যেও দুজন পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কৃতরা হলেন নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ও সালমা বাণী। এই দুজনের একজন নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরকে নিয়ে বলব বলেই এই লেখার অবতারণা করেছিলাম। কথায় কথা বেড়ে গেল।
জাহাঙ্গীর ভাই আর আমি এক শহরে, প্রায় একই সময়ে বড় হয়েছি। তাঁর সঙ্গে যখন পরিচয় হয় তখন আমি কলেজে পড়ি, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছেন। তার আগে থেকেই লেখালেখি করতেন। তবে প্রথম গল্পের বই ‘ভোরের জন্য প্রতীক্ষা’ বের হয়েছে বেশ দেরি করে, ২০০১ সালে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উদ্বাস্তু’ লিখেছেন ২০০৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে। আমার জানা মতে, এটি রোহিঙ্গাদের নিয়ে লেখা প্রথম সাহিত্যকর্ম।
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের ‘সোলেমন’, ‘কেঁচো’, ‘জাল থেকে জালে’, ‘মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল’, ‘বিলডাকিনি’, ‘দায়ভাগ’, ‘আদমসুরত’ ও ‘থাকে শুধু অন্ধকার’ উপন্যাসগুলো বাজারে পাওয়া যায়। উপন্যাসগুলোর প্রকাশকরাও তাচ্ছিল্য করার মতো নন, তবু আমার বন্ধুদেরই কেউ কেউ নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের নামটি পর্যন্ত শুনতে পাননি। তাঁদের শুনতে না পাওয়ায় আমার আপত্তি নেই, আপত্তি তাঁদের আলটপকা মন্তব্যে
আগেই বলেছি, নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের প্রথম উপন্যাস ‘উদ্বাস্তু’ রোহিঙ্গাদের নিয়ে লেখা। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে যখন রোহিঙ্গা ঢল নামে আমি রিপোর্ট করতে গিয়েছিলাম সমকালের হয়ে। এ বিষয়ে বুঝবার জন্য বারবার টেকনাফ থেকে ফোন করেছি জাহাঙ্গীর ভাইকে। মিয়ানমার যে রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলতে চায়, ফ্রান্সিস বুকাননের উদ্ধৃতি দিয়ে তার যুক্তিহীনতা বুঝিয়ে দিয়েছেন সহজ করে।
নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ‘উদ্বাস্তু’ উপন্যাসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবন ইতিহাস ও নৃতাত্ত্বিক দিক থেকেও দেখতে চেষ্টা করেছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা ২০১৭ সালে নতুন রূপে দেখা দিলে লিখেছেন ‘সোলেমন’। শুধু কথাসাহিত্যে নয়, গবেষণায়ও নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ভিন্ন কিছু তুলে আনবার চেষ্টা করেছেন। ইউনানী-আয়ুর্বেদ চিকিৎসাব্যবস্থার পলিসি পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে পিএইচডি করেছেন। সমতলের আদিবাসীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত অঞ্চল ধরে করেছেন বেশ কিছু অন্যরকমের কাজ।
Discussion about this post