চট্টগ্রাম,৩১ মে, ২০২৪:
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় দিনমজুর মাহামুদুল হককে ছুরিকাঘাত করে খুন করার ৪৮ ঘণ্টা অতিবাহিত না হতেই ধান চুরির ঘটনায় কয়েক দফা পিটিয়ে সদ্যবিবাহিত মো. মহিউদ্দিন (২৫) নামে এক পিকআপ চালককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। গত বুধবার (২৯মে) রাত ৮ টার দিকে উপজেলার আমিলাইষ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড দক্ষিণ আমিলাইষ শাহ পারওয়াল বাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সন্ধ্যা ৬ টার দিকে পিকআপ চালককে গাড়িসহ আটক করে কয়েক দফা পিটানোর পর চালক মারা যান। তবে মারা যাওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র পিটুনি নাকি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল ।
চালক মহিউদ্দিন উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড সর্দারপাড়া লম্বা কালুর বাড়ির আলী আহমদের ছেলে।
নিহতের মা রোকসানা আকতার বলেন, আমার ছেলে একজন পিকআপ চালক। গত কয়েকদিন ধরে একটি ধানের ভাড়ার জন্য আমিলাইষ ইউনিয়নের সরওয়ার বাজার থেকে তাকে কল দিচ্ছে বলে আমাদেরকে জানায়। বুধবার (২৯ মে) সকাল ১০ টায় সে গাড়ি নিয়ে ঘর থেকে বের হয় এবং রাত আনুমানিক ৮ টার দিকে ধান লোড করতে সরওয়ার বাজার গিয়েছে বলে জানতে পারি। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমার মোবাইলে একটি কল আসে। মোবাইলের অপরপ্রান্ত থেকে আমার ছেলে বলে উঠে ‘মা আমাকে বাঁচাও, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে’। এটি বলার পরপরই কলটি কেটে যায়। রোকসানা আরও বলেন, আমার ছেলের বিয়ে হয়েছে মাত্র ২২ দিন হয়েছে। আমার ছেলে নিরপরাধ। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।
নিহত মো. মহিউদ্দিনের সহকর্মী (চালক) নবী হোসেন নাহিদ জানান, বুধবার সন্ধ্যার দিকে কেরানিহাট গরু বাজারের সামনে থেকে মিলে ধান নেওয়ার জন্য কল দিয়ে তাকে (মহিউদ্দিন) নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক সে গাড়ি নিয়ে ভাড়ার জন্য বের হয়। এক পর্যায়ে এক অপরিচিত মোবাইল ফোন নম্বর থেকে আমার মোবাইলে কল আসে- অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়- মহিউদ্দিন এখনো ধান নিতে আসেনি। সাথে সাথে আমি মহিউদ্দিনকে কল দিলে তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
নিহত মহিউদ্দিনের প্রতিবেশী আবদুল মান্নান জানান, রাতে হঠাৎ করে এক পরিচিত লোকের মাধ্যমে জানতে পারি মহিউদ্দিনের লাশ সরওয়ার বাজারের কাছেই রাস্তার ধারে পড়ে আছে। সাথে সাথে তার পরিবারসহ আমরা গিয়ে লাশটি সনাক্ত করি। এ সময় লাশের আশপাশে কোন মানুষজন ছিল না। বিষয়টি সাতকানিয়া থানা পুলিশকে জানালে তারা এসে লাশটি উদ্ধার করে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. মো. সাদত ইসলাম মিরাজ বলেন, বুধবার রাত ৩ টায় পুলিশ এক যুবককে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে আসে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে হাসপাতালে নিয়ে আসার প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা আগে ওই যুবক মারা গেছে। তার শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
এলাকায় সরেজমিন বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, ভিন্ন ভিন্ন কথা। স্থানীয়দের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এলাকাবাসী জানান, আমিলাইষ শাহ পারওয়াল মাদ্রাসার নতুন ভবনে স্থানীয় কৃষক ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবের কারণে মো. সায়েম, মো. কামরুল মো. আইয়ুব ও মো. হেলাল জমি থেকে অগ্রিম ধান কেটে বস্তাভর্তি করে রাখে। গত শুক্রবার (২৫মে) সকালে পিকআপে করে সুযোগ বুঝে ২০ বস্তা ধান নিয়ে যায় চোরের দল। এ সময় ধানের মালিকরা মনে করেন, তাদের মধ্যে যে কেউ ধান বিক্রি করে দিয়েছে, সেই ধান ক্রেতারা নিয়ে গেছে । পরের ধানের মালিকরা এক হলে বুঝতে পারে তাদের ধান চুরি হয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে এলাকার লোকজন ও স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ অভিযোগ কেন্দ্রের এক দারোয়ানসহ পাহারায় থাকেন এলাকাবাসী। এর প্রেক্ষিতে বুধবার রাতে একটি পিকআপে করে পুনরায় ধান চুরি করতে গেলে আগে থেকে সজাগ থাকা বিক্ষুব্ধ জনতা চোরদের ধাওয়া করলে ৩ চোর পালিয়ে যায়। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা চালক মহিউদ্দীনকে গণপিটুনি দিলে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান। এ সময় জনতা পিকআপটি ভাংচুর করে।
এ প্রতিবেদকের হাতে আসা একটি ভিডিও ফুটেজ থেকে চালক মহিউদ্দীনকে বলতে দেখা যায়, গতবার চুরি করে নিয়ে যাওয়া ২০ বস্তা ধান ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। মহিউদ্দিন তার ভাগে ৫ হাজার টাকা পায় বলে জানায়।
মহিউদ্দিন আরও বলেন, চোর ছিল তিন জন। এর মধ্যে মহিউদ্দিন কারো নাম না জানলেও এক জনের মোবাইলের শেষ নাম্বার ৮০ থেকে ফোন করা হয় বলে জানান।
অপরদিকে স্থানীয় ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য লোকমান হাকিম মনু বলেন, বুধবার রাত সাড়ে ৮ টা থেকে সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত তিন স্থানে কয়েক দফায় শারীরিক নির্যাতন করা হয় চালক মহিউদ্দিনকে।
অন্যদিকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. মহিউদ্দিন জানান, আনুমানিক ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১০/১২ জন যুবক এক ব্যক্তিকে পেটাচ্ছে। এদের মধ্যে হেলাল, জিহান, বাবুল ও কামরুলকে আমি চিনি। ছদাহা ইউনিয়ন (ইউপি) পরিষদের ১নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মুজিবুর রহমান মুজিব বলেন, পিকআপ চালক মহিউদ্দিনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। সে কখনও এ ধরনের কার্যকলাপের সাথে যুক্ত থাকতে পারেনা। না জেনে হয়ত সে ভাড়ায় গিয়েছিল তাই চোরের দল পালিয়ে গেলেও সে গাড়িতে বসে ছিল। তাকে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হয়েছে। এটি একটি অমানবিক ঘটনা।
সাতকানিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রিটন সরকার বলেন, এক সপ্তাহ পূর্বে ২০ বস্তা ধান চুরি হয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা পাহারা বসিয়েছিল। এমতাবস্থায় চোরের দল ৫ বস্তা ধান গাড়িতে তুলে। এ সময় পাহারায় থাকা লোকজন এগিয়ে আসলে চোরের দল পালিয়ে যায়। পরে গাড়িতে থাকা চালককে গণপিটুনি দেয় উত্তেজিত জনতা। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছবি: নিহত মহিউদ্দিন
Discussion about this post