চট্টগ্রাম, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২২:
এখন চলছে ভ্রমণের মৌসুম। করোনার প্রাদুর্ভাব কমে আসায় ঘর থেকে বেরিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসতে চাইছে সামর্থ্যবান মানুষজন। তবে বেশি দূরে না গিয়েও, কম খরচে স্বল্প সময়ের ভ্রমণ হিসাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধ হতে পারে ভ্রমণের জন্য একটি মনমত জায়গা। কেন সেখানে বেড়াতে যাওয়া দরকার। কারণ তিনিই এদেশের জনক। বাঙালির মুক্তিদাতা।যার আগে অনেকের সংগ্রাম, আন্দোলন সত্ব্বেও বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীন দেশের ঠিকানা নিশিবচত করতে পারেনি। সে হিসাবে জাতির পিতার সমাধিসৌধ ঘুরে আসা ভ্রমণপ্রিয়, সামর্থ্যবান প্রতিটি বাঙালির কর্তব্য। এটা হবে জাতির প্রতি শ্রদ্ধা, স্মরণ ও ভালোবাসার প্রকাশও।
মধুমতি নদীর তীরে পাটগাতির পরেই টুঙ্গিপাড়া। গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে এই টুঙ্গিপাড়া। নির্জন-নিরিবিলি উপজেলা শহর এখন। এখানে চারদিকে গাছগাছালি, ফল ও বিল। যেন ছবির মতো সাজানো। এই টুঙ্গিপাড়ায় বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি। বঙ্গবন্ধুর সমাধির পাশেই তার বাড়ি। এখানে ঢুকতেই পাথরের গায়ে লেখা রয়েছে–’দাঁড়াও পথিক বর যথার্থ বাঙালি যদি তুমি হও। ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধিস্থলে। এখানে ঘুমিয়ে আছে, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। এ দেশের মুক্তিদাতা, বাংলার নয়নের মণি।’
লাল সিরামিক ইট আর সাদা-কালো মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত এই সৌধের কারুকাজে ফুটে উঠেছে বেদনার চিহ্ন। কমপ্লেক্সের সামনে, দুই পাশের উদ্যান পেরোনোর পরই বঙ্গবন্ধুর কবর। পাশে তার বাবা ও মায়ের কবর। এই তিন কবর নিয়েই গড়ে উঠেছে গোলাকার গম্বুজবিশিষ্ট মূল সমাধিসৌধ। সমাধি কমপ্লেক্সটি ৩৮.৩০ একর জমির উপর অবস্থিত। সমাধিটি একটি গম্বুজ দ্বারা ঘেরা।সব সময় আলোছায়ার মায়াবী খেলা সেখানে। ওপরে থাকা কারুকাজ করা কাচের ভেতর দিয়েও আলো ছড়িয়ে পড়ে সমাধিতে। চারদিকে কালো, মাঝখানে সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কবর বাঁধানো। ওপরের অংশ ফাঁকা। কবরগুলো সাদা মার্বেল পাথরে বাঁধানো। সমাধিসৌধের উপরের অংশ সাদা পাথরে তৈরি একটি গোলাকার গম্বুজ। গম্বুজের দেয়াল জাফরি কাটা। জাফরি কাটা অংশ দিয়ে সূর্যের আলো কাঁচের কারুকাজের মধ্য দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। যে কোনো সমাধি দেখলে ব্যক্তিগতভাবে মনের গভীরে বেদনার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যে মানুষগুলোর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিগত বা সামাজিক সম্পর্ক থাকে। যে মানুষটি সমাধিতে শুয়ে আছেন, তিনি ব্যক্তি বা পরিবারের উর্ধ্বে উঠে একটি জাতির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভয়াবহ নিপীড়ন এবং দুঃসহ শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতির মুক্তির কাণ্ডারি হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ কথা তার কঠোর সমালোচকরাও অস্বীকার করতে পারেন না। এই বিশাল মহীরুহ হয়ে ওঠা নেতাকে দেশী-বিদেশী চক্রান্তের মাধ্যমে কতিপয় কুচক্রী সামরিক অফিসার নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করে। কঠোর গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করে শুধু বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায় এনে দাফন করা হয়। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দাফন করা হয় বনানী কবরস্থানে। যুক্তরাজ্যে অবস্থানের কারণে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা ঘাতকের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান।
এই কমপ্লেক্সে রয়েছে একটি পাঠাগার ও জাদুঘর। পাঠাগারে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বইসহ প্রায় ছয় হাজার বই রয়েছে। রয়েছে গবেষণাকেন্দ্র, প্রদর্শনী কেন্দ্র, উন্মুক্ত মঞ্চ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটেরিয়া, বকুলতলা চত্বর ও স্যুভেনির কর্নার।
প্রদর্শনী কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের নানা পর্যায়ের আলোচিত্র ছাড়াও রয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা শিল্পকর্ম। এছাড়া মুক্তিসংগ্রামের নানা পর্যায়ের দেশ ও বিদেশ থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্র। বঙ্গবন্ধুকে যে কফিনে করে ঢাকা থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে করে নিয়ে আসা হয়েছিল, সেটিও সংরক্ষণ করা হয়েছে যত্নসহকারে। দর্শনার্থীরা এখানে এসে আবেগে আপ্লুত হন। শ্রদ্ধা জানান বঙ্গবন্ধুকে।
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সমাধিসৌধ খোলা থাকে। পাঠাগার খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সের পাশেই টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে ‘শেখ রাসেল শিশুপার্ক’। সেখানেও ঘুরে আসা যায়। সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স শুধু নয়, এর আশপাশের এলাকায় আরও অনেক কিছুই দেখার রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদি পৈতৃক বাড়ি, ছেলেবেলার খেলার মাঠ, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বালিশা আমগাছ, শেখ বাড়ি জামে মসজিদ (স্থাপিত হয়েছে ১৮৫৪ সালে) ইত্যাদি। আছে হিজলতলা ঘাট, যেখানে বঙ্গবন্ধু ছোটবেলায় গোসল করতেন। দেখা মিলবে শেখ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী একটি বড় ও একটি ছোট আকারের পুকুরের।
ঢাকা থেকে সারসরি বাসে টুঙ্গিপাড়া যাওয়া যায়। বাসের রয়েছে দুটি রুট। একটি গাবতলী থেকে পাটুরিয়া হয়ে, অপরটি গুলিস্তান থেকে মাওয়া ঘাট পার হয়ে। গাবতলী থেকে টুঙ্গিপাড়ার দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার। গোল্ডেন লাইন, সেবা গ্রিন লাইন, কমফোর্ট লাইন নামের বাসে টুঙ্গিপাড়া যেতে সময় লাগে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর বাস পাওয়া যায়।
গুলিস্তান থেকে টুঙ্গিপাড়ার দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটার। এই পথে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস, সেবা গ্রিস লাইন ও মধুমতী পরিবহনের বাসে চড়ে টুঙ্গিপাড়া যাওয়া যায়। প্রতি আধা ঘণ্টা পরপর বাস পাওয়া যাবে।
টুঙ্গিপাড়ায় (Tungipara) থাকার জন্যে বেশকিছু হোটেল রয়েছে। তাদের মধ্যে কালীবাড়ি রোডে হোটেল জিমি এবং রেল রোডে হোটেল মমতাজ উল্লেখযোগ্য।
ব্যক্তি উদ্যোগ ছাড়াও ভ্রমণ সংক্রান্ত বিভিন্ন সংগঠনও এ ধরনের ভ্রমণের আয়োজন করে থাকে। এখন যাওয়ার পথে পদ্মা সেতু ভ্রমণের সুযোগও রয়েছে। তাই বাঙালি জাতির তীর্থ স্থানটি ঘুরে আসার পরিকল্পনা করাই যায়। যদি কখনো না যাওয়া হয়, তাহলে নিজে কিংবা সপরিবারে ঘুরে আসা যায়।
জাতির পিতার সমাধি কমপ্লেক্স নির্মাণ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। কমপ্লেক্সের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ১৭ মার্চ ১৯৯৯-এ এবং উদ্বোধন করা হয় ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি
Discussion about this post