চট্টগ্রাম,২১ আগস্ট, ২০২৩
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, শনিবার। বিকেলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সমাবেশ। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সমাবেশে অন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য সমাপ্তির দিকে। তখন আনুমানিক বিকেল সাড়ে ৫টা। হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেল নারকীয় গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে লাগল একের পর এক গ্রেনেড। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ মুহূর্তেই পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহুর্মুহু গ্রেনেড হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্ত-মাংসের স্তূপে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। দলের অনেক নেতাকর্মী এদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও এখনো দেহে অসংখ্য ঘাতক স্পিন্টারের তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে পথ চলছেন তারা।
সেদিন নিহত হন ২৪ জন । আহত হন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মি সহ প্রায় তিন শত মানুষ।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার এভাবেই বর্ণনা দেন
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। তিনি বলেন, সেই বিভৎস দৃশ্য আর পাষণ্ডদের হিংস্র তাণ্ডব আজও যেন চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভাসে। মৃত্যু আর রক্তস্রোতের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজও তাড়া করে। আমরা যেন জীবিত থেকেও মৃত। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর সেই সময়কার মুখগুলো এখনো আমাকে তাড়া করে। হয়তো আমৃত্যু তাড়া করেই যাবে। কারণ চোখের সামনেই সেদিন আমি কেয়ামত দেখেছিলাম। প্রিয় মানুষদের এভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার দৃশ্য দেখে নিজের আহত হওয়ার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম। পরবর্তীতে আকস্মিক জ্ঞান ফিরলে জানলাম আমি আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকরা আমাকে জানালেন, নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের কয়েকজন অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে ধরে নিয়ে এসেছেন।
সেদিন দেশের আজকের দেশে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মানববর্ম তৈরি করে তার প্রাণ রক্ষা করেন নেতাকর্মিরা। এর মধ্যে মুহুর্মুহু গ্রেনেড আর গুলির শব্দ। গুলি থামার পর চাক্ষুস হয়ে উঠে ভয়ানক বিভীষিকা। চারদিকে আর্তনাদ, গোঙ্গানি। রক্তাক্ত পড়ে আছে বহু নারী পুরুষ। কে জীবিত কে মৃত বোঝা মুশকিল।
আহতদের মধ্যে অনেকের জীবনযাপন দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেও, কানে আঘাত পান, যার প্রভাবে আজ পর্যন্ত তিনি ভুগছেন।
ঘটনার দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর মতিঝিল থানায় দায়ের করার হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে
ঘটনার দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর মতিঝিল থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে।
এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী আরও দুটি মামলা করেছিলেন।পরে এসব মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। মাত্র এক মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। যা ছিল পুরোপুরি ঘটনাকে আড়াল করার ঘৃণ্য সরকারি প্রচেষ্টা।
মামলা জজ মিয়াকে আর ঘৃণ্য নাটক তৈরি করে পুলিশ। ২০০৯ সালে জজ মিয়াকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ই জুন মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির জ্যেষ্ঠ এএসপি ফজলুল কবির।
২০০৯ সালের ৩রা অগাস্ট রাষ্ট্রপক্ষ মামলাটি অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। এরপর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আখন্দ।
তিনি ২০১১ সালের ৩রা জুলাই বিএনপি নেতা তারেক রহমানসহ ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ৫২ জনের নামে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দেন।
২০১১ সালের ৩রা জুলাই সম্পূরক চার্জশীট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি।
দুটি পৃথক ট্রাঙ্কে ভর্তি করে আনা চার্জশীটে নতুন করে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।এর আগের চার্জশীটে ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। নতুনভাবে অভিযুক্তদের মধ্যে স্থান পান বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।
এ মামলায় আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ জনে।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত।পুরনো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ের সময় ৩১ জন আসামিকে কারাগারে হাজির করা হয়।
Discussion about this post