চট্টগ্রাম, ০৫ অক্টোবর, ২০২৩:
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস) এর আয়োজনে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার মিলনায়তনে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, জেন্ডার একটি সাংস্কৃতিক নির্মাণ। শুধু লৈঙ্গিক পরিচয়ে কেউ অসমতার শিকার হয় তেমনটা নয়। ধর্মীয় বিধিনিষেধ, সামাজিক অবস্থান ও প্রান্তিকতা এসব কারণেও নারী বৈষমে্যর শিকার হয়। সমাজকে আলোকিত করা, সত্য জানানো, অধিকার নিশ্চিত করা শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব। কার্য কারণ সম্পর্ক ছাড়া কিছুই ঘটে না। সমাজের মধ্যে থেকেই চেতনা জাগিয়ে তোলা জরুরি, আর এক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও একটি ভূমিকা রয়েছে।
সেমিনারে প্রধান আলোচক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌলা বলেন, আমাদের পারিপার্শ্বিকতাই আমাদের মানসিকতা নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজ ব্যবস্থা দুই হাজার বছর আগে কেমন ছিল, আর কিছু দিন পর কেমন থাকবে দুটোই ভিন্ন চিত্র। সমাজ গঠনকে জানতে হবে। এক সময় সতীদাহ ছিল, নারী শিক্ষা ছিলনা। বিদ্যাসাগর ও বেগম রোকেয়ার অবদান আমরা জানি। ভবিষ্যতের মানুষও আমাদের আজকের অবস্থান বিবেচনা করবে। তাই সবাইকে মানবিক হতে হবে। ধর্ম নিরপেক্ষতার বিষয়টি ৭২ এর সংবিধানে এমনিতে আসেনি, ঐতিহাসিকভাবে এসেছে। স্বাধীনতার আগে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার আমরা দেখেছি, এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর সময়ে তৈরি সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতার বিষয়টি এসেছিল। সমাজকে আলোকিত করা, সত্য জানানো, অধিকার নিশ্চিত করা শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব। কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়া কিছুই ঘটেনা। সমাজের মধ্যে থেকেই চেতনা জাগ্রত করতে হবে। আর রাষ্ট্রের ভূমিকাও বিশাল।
সেমিনারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলা উদ্দিন বলেন, নারীদের জন্য কিছু আসন সংরক্ষণ করে কি আসলে সমাজের দৃষ্টি পাল্টানো গেছে? তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কি আসলে আমরা মানুষ মনে করি? সংবিধানের শুরুর মূলনীতিগুলো থাকা জরুরি। পাশাপাশি প্রাত্যহিক জীবনে আমরা তা অনুসরণ করা সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষ শাসিত একটা সমাজে আমরা আছি, প্রশাসন ও রাজনীতিতে কিছু নারী বড় পদে আছেন, কিন্তু তারা নারীর প্রতিনিধিত্ব করছে কিনা সেটিও ভেবে দেখা দরকার। গণতন্ত্র থাকলেই অনেক বিষয় নিশ্চিত হয়ে যায়। সুসম বিকাশ ও দুর্যোগ মোকাবিলায় নারীর অধিকার করা জরুরি, এক্ষেত্রে পুরুষদের এগিয়ে আসা উচিত। নারীদের নিরাপত্তা না থাকলে তাদের অধিকার প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করা যাবে না। নারীর জন্য যেসব গৎবাঁধা নিয়ম চালু আছে সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে।
নৃ বিজ্ঞান সহকারী অধ্যাপক ড. মোশরেকা অদিতি হক বলেন, জেন্ডার একটি সাংস্কৃতিক নির্মাণ। শুধু লৈঙ্গিক পরিচয়ে কেউ অসমতার শিকার হয় তেমনটা নয়। ধর্মীয় বিধিনিষেধ, সামাজিক অবস্থান ও প্রান্তিকতা এসব কারণেও নারী বৈষ্যমের শিকার হয়। অধিকার, শিক্ষা, সম্পত্তি ও শ্রমের অধিকার সব মিলিয়েই নারী অধিকার। পুরুষতন্ত্রের বীজ অনেক গভীরে। শুধু যে এ উপমহাদেশে তা আছে তেমন নয়। সারা বিশ্বেই আছে। সমতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তাই চিরন্তন। আমাদের অনেক অর্জন এখনো বাকি। মুক্তিযুদ্ধের পর সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেখান থেকে আমরা অনেক দূরে সরে গিয়েছি। কিছু বিষয়ে একমত হয়ে দেশ গড়ার কাজ শুরুর যে কথা ছিল তাও হয়নি। কিছু প্রশ্নে এখনো বিতর্ক চলমান। নারীরা অনেকে এখন উপার্জন করছেন তবে পারিবারিক সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন কিনা, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। গার্হস্থ্য শ্রমে নারীর মূল্য নিশ্চিত করতে পারিনি। রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ রাইট নিশ্চিত হয়নি। সম্পত্তির অধিকারে রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যেই পার্থক্য রয়েছে, পাশাপাশি ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন ও সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রভাষক নওশীন ইসলাম বলেন, এই আধুনিক সমাজেও নারীকে পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাধান্য দেয়া হয় না। অর্ধেক শিক্ষার্থী নারী হওয়ার পরও তাদের সুবিধা, অসুবিধা নিয়ে কেউ চিন্তা করছে না। নারীর প্রতি সহিংস আচরণ কমছে না, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনলাইনে যৌন হয়রানি। ঘরে বাইরে সমাজে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সবাইকে নারীর অধিকার নিশ্চিতে সক্রিয় হতে হবে।
বিএনপিএস কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্মসূচি সমন্বয়কারী ও সেমিনারের সভাপতি মনিরুজ্জামান মুকুল বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় ইহজাগতিকতার চর্চার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এখনকার বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও ধর্ম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। পরজগতে রাষ্ট্রের কোনো কাজ নেই। তাই আমরা বলেছি রাষ্ট্রীয় কাজে ধর্মকে একটু পাশে রাখতে।
ধারণাপত্র উপস্থাপন করে বিএনপিএস চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক ফেরদৌস আহমদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নারী পুরুষ সকলের অংশগ্রহণ ছিল। রাষ্ট্রের মূলনীতি ছিল সমতা, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায় বিচার। কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করবে না। তবে এখন সহিংসতায় ধর্মীয় বিষয়কে ইস্যু করা হচ্ছে। এর নির্মম শিকার হচ্ছে নারীরা। নারীরা এখনো সব জায়গায় বৈষম্যের শিকার। জেন্ডার সমতা ও সমনাগরিকত্ব প্রতিষ্ঠায় তরুণদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে শরীফ চৌহান বলেন, জেন্ডার সমতা একটি বৈশ্বিক ধারণা হলেও বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে এর আছে গভীর যোগ। আমাদের স্বাধীনতার রাজনৈতিক সংগ্রামে এই বিষয় সম্পৃক্ত ছিল। নারী পুরুষের সম ভোটাধিকার আমাদের দেশে আছে। সংবিধান অনুসারে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে নানা উদ্যোগ আছে। পার্থিব অধিকার আদায়ে বৈষম্য আইনত দণ্ডনীয়। সকল অর্জন পুরোপুরি লাভ করতে হলে নারীদের অধকার নিশ্চিত করতে হবে।
সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন- বিএনপিএসের রুনা শাকিল আরা, এস এম এরশাদ উল করিম, তপন কান্তি, বিপ্লব দাশ, আবদুল করিম ও তানজিনা নূর। বিজ্ঞপ্তি
Discussion about this post