চট্টগ্রাম, ১৭ এপ্রিল, ২০২২:
সন্দ্বীপ উপজেলার কালাপানিয়া ইউনিয়নের পশ্চিমে জেগে ওঠা বিশাল নতুন চর, যা মূলত একসময় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া সন্তোষপুর, বাওয়া, রুহানী, কালাপানিয়া, রহমতপুর, আমানউল্ল্যা, বাটাজোড়া, কাটগর, দুবলাপাড়, হুদ্রাখালি, কাজিরখিল সহ সন্দ্বীপেরই বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম। সন্দ্বীপের মূল ভূখ-ের সঙ্গে নতুন চরের যোগাযোগে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাঝখানের ১০০০ ফুট প্রশন্ত পানিপ্রবাহ। সেই বাঁধা দূর করতে পানিপ্রবাহের উপর বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন বাস্তুচ্যুত কয়েক হাজার মানুষ। একসময় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে ফিরে যাওয়ার স্বপ্নে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৪০০০ ফুট দৈর্ঘ্য, ৫০ ফুট প্রস্থ ও ৩০ ফুট উচ্চতার সড়ক-বাঁধ নির্মাণের বিশাল এ কর্মযজ্ঞ শুরু হয় ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ সালে। বর্তমানে নির্মিত হয়েছে ৩০০০ ফুট সংযোগ সড়ক এবং পানিপ্রবাহের উপর মূল বাঁধের ১০০০ ফুটের প্রায় ৯৫০ ফুট। বাকি ৫০ ফুটের নির্মাণ কাজ শেষ হলে বঙ্গোপসাগরের মেঘনা মোহনায় জেগে ওঠা বিশাল চর যুক্ত হবে সন্দ্বীপের মূল ভূখ-ের সঙ্গে।
কালাপানিয়া-বাটাজোড়া সংযোগ সড়ক বাস্তবায়ন কমিটির সহ-সভাপতি আবদুর রহমান রিপন বলেন, আমাদের মূল উদ্দেশ্য সন্দ্বীপের মূল ভূখ-ের সঙ্গে জেগে ওঠা চরের সংযোগ স্থাপন। বাঁধ নির্মাণ হলে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে আরও পলি জমে নতুন চর ও মূল ভূখ- এক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ধীরে ধীরে চরের উচ্চতাও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, জেগে ওঠা চরে এখন বসতবাড়ি গড়ে তোলা সম্ভব না হলেও, বাঁধ নির্মাণের পর স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের নিজের জমিতে চাষাবাদ করতে পারবেন। গবাদিপশুর বিচরণক্ষেত্র গড়ে উঠবে। এই বাঁধ নির্মাণের পর স্থলপথেই সন্দ্বীপ থেকে নোয়াখালীর স্বর্ণদ্বীপের কাছাকাছি পর্যন্ত যাওয়া যাবে। অদূর ভবিষ্যতে নোয়াখালীর সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগেরও সম্ভাবনাও তৈরি হবে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পানিপ্রবাহের পশ্চিমে নতুন জেগে ওঠা চরে দুটি স্কেভেটর মেশিন দ্বারা মাটি ভরাটের কাজ চলছে। মূল ভূখ- থেকে ১৮টি হাইড্রোলিক ট্রাকে করে মাটি এনে চলছে পানিপ্রবাহের উপর বাঁধ নির্মাণের কাজ। নির্মিত বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে নির্মাণ কাজের খোঁজখবর নিচ্ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন।
তাদেরই একজন হরিশপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা নুরুল আফসার। তিনি বলেন, আমার জন্মের পূর্বে ভেঙে যায় কাজিরখিল ইউনিয়ন। সেখানে ছিল পূর্বপূরুষের বসতভিটা। এরপর ১৯৭৮/৭৯ সালের দিকে পূর্বপুরুষ বসতি স্থাপন করে দুবলাপাড় ইউনিয়নে। সেটিও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
মোট তিনবার নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারানোর পর বর্তমানে তারা বসতি স্থাপন করেছেন সন্দ্বীপের হরিশপুর ইউনিয়নে।
নুরুল আফসার আরো বলেন, বাঁধ নির্মাণ হলে আমার মতো আরও হাজার হাজার মানুষ তাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। পূর্বপূরুষের হারানো ভিটেমাটিতে পা রাখতে পারবে নতুন প্রজন্ম।
১৯১৩ সাল থেকে ১৯১৬ সালের সিএস ম্যাপ অনুযায়ী সন্দ্বীপের মূল ভূখ-ের সাথে জেগে ওঠা স্বর্ণদ্বীপ ও ভাসমান চরগুলোসহ ৫৯২ বর্গকিলোমিটারের সীমানা নির্ধারণ করে সন্দ্বীপ উপজেলাধীন ঘোষণা করা, দেশে বিদেশে বসবাসরত প্রায় ১২ লক্ষ সন্দ্বীপের নদী সিকস্তিতে প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও বাস্তু ভিটে-বাড়িহারাদের পুনর্বাসন, সন্দ্বীপের সীমানাভুক্ত ৫৯২ বর্গকিলোমিটারের চরগুলো সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় আইনকানুন সংশোধন ও পরিবর্তন করে পুনর্বাসন ও খাসভূমির জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করাসহ ৭টি সুনির্দিষ্ট দাবি আদায়ের লক্ষে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছে সন্দ্বীপ নদী সিকস্তি পুনর্বাসন সমিতি।
সন্দ্বীপ নদী পুনর্বাসন সমিতির সদস্য সচিব মনিরুল হুদা বলেন, আমরা সমিতির উদ্যোগে সন্দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় বাস্তুচ্যুত মানুষজনকে নিয়ে নিয়মিত সমাবেশ করছি। তাদের ন্যায্য পাওনা সম্পর্কে অবহিত করছি। সবাইকে একত্রিত করার চেষ্টা করছি। সমিতির অনেক সদস্য বাঁধ নির্মাণে বিভিন্নভাবে উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করছেন।
নির্মাণাধীন এ সড়ক-বাঁধ নির্মাণের মূল উদ্যোক্তা কালাপানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়্যারম্যান আলিমুর রাজী টিটু বলেন, সন্দ্বীপের মূল ভূখ-ের সঙ্গে জেগে ওঠা নতুন চরকে যুক্ত করতেই মূলত বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাঁধ নির্মাণ হলে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে পলি জমে সন্দ্বীপ ও নতুন চরগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৮ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১৫০০ ফুট বাঁধে ওঠার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, পানিপ্রবাহের উপর ১০০০ ফুট মূল বাঁধসহ বাকি ২৫০০ ফুট সড়ক ও বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে স্থানীয়দের উদ্যোগে, যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬০ লক্ষ টাকা।
Discussion about this post