চট্টগ্রাম, ১১ মে, ২০২২:
সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম নেয়ার পথে প্রসব পূর্ববর্তী জটিলতায় কুলসুমা বেগম(২৪) নামে এক প্রসূতির হৃদয়বিদারক মৃত্যু হয়েছে গতকাল বুধবার দুপুরে। তিনি সন্দ্বীপ পৌরসভার বাগেরহাট এলাকার রাজমিস্ত্রী সাইফুলের স্ত্রী। বুধবার দুপুরে সন্দ্বীপ চ্যানেলে গুপ্তছড়া-কুমিরা রুটে নৌযান সঙ্কটের কারণে যাত্রাপথে বিলম্ব হওয়ায় গর্ভবতী এই নারীর মৃত্যু হয়।
এদিকে গত ২৫ এপ্রিল, সোমবার সন্ধ্যায় আছমা বেগম(৪৫) নামের এক নারী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে স্থানীয় স্বর্ণদ্বীপ হাসপাতালে ভর্তি করান রোগীর স্বজনেরা। প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। কিন্তু রোগীর স্বজনেরা গুপ্তছড়া ঘাট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে ঘাট কর্তৃপক্ষ জানান, রাতের বেলা কোন নৌযান ছাড়া সম্ভব নয়। পরবর্তীতে উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় একটি ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকার (সার্ভিস বোট) মাধ্যমে রাত ১২ টার পর রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রামে।
এর আগে গত ২৩ এপ্রিল, শনিবার সকাল আটটার দিকে বিষাক্ত পোকার কামড়ে মুমূর্ষু শিশু আনিকাকে(৬) নিয়ে স্থানীয় সন্দ্বীপ মেডিকেল সেন্টারে প্রাথমিক চিকিৎসার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য রোগীকে তাৎক্ষণিক চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলে দুপুর দুইটার দিকে গুপ্তছড়া ঘাটে আসেন স্বজনেরা। ঘাটে দ্রুত রোগী পারাপারের কোন ব্যবস্থা না থাকায় বিপাকে পড়েন তারা।
শিশুটির চাচা খোদাবক্স সাইফুল পরে ৫০০০ টাকা দিয়ে একটি ইঞ্জিন চালিত কাঠের নৌকায় করে রোগীকে চট্টগ্রাম নিয়ে আসেন। সময় লাগে দেড় ঘন্টা।
সন্দ্বীপের এমন অনেক আশঙ্কাজনক রোগীর বাঁচামরা বিষয়টি নির্ভর করছে সন্দ্বীপের ঘাটে এসে দ্রুত নৌযান সার্ভিস পাওয়া না পাওয়ার উপর। এ ধরনের রোগীদের বেশিরভাগই গর্ভবতী মা ও শিশু।
যেভাবে মারা যান প্রসূতি কুলসুমা : বাড়িতে প্রাথমিকভাবে কুলসুমা বেগমের ডেলিভারির চেষ্টা করা হয় গ্রামের ধাত্রী দিয়ে। তখন কুলসুমা বেগম অজ্ঞান হয়ে পড়েন। বাড়িতে ডেলিভারির চেষ্টা ব্যর্থ হলে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে সন্দ্বীপ মেডিকেল সেন্টারে নেয়া হয় ভোর ৪ টার দিকে। সেখানকার মিডওয়াইফরা প্রাথমিক চেক আপের পর রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে তাকে চট্টগ্রাম নগরে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। স্বজনরা দ্রুত রোগীকে গুপ্তছড়া ফেরিঘাটে নিয়ে যায়। সকাল সাতটায় স্টিমার সার্ভিসে করে তাকে সীতাকু-ের কুমিরা ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল সাড়ে দশটার দিকে একটি ভাড়া করা গাড়িতে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলে হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন প্রসূতি কুলসুমা। পরে জাহাজের ফিরতি সার্ভিসে কুলসুমার লাশটিই সন্দ্বীপে নিয়ে আসা হয়।
সন্দ্বীপের জরুরি রোগী ও দুর্যোগকালীন সেবা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২টি সি অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছিল। যেগুলোর দাম প্রায় কোটি টাকা। কিন্তু দুটি অ্যাম্বুলেন্সই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া অ্যাম্বুলেন্সটি সমুদ্রে নয়, হাওরে চলাচলের উপযোগী।
অন্যটি এক বছর চলার পর বন্ধ রয়েছে। আরেকটি চলেনি একদিনও। দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখায় পরিত্যক্ত হয়ে গেছে সি-অ্যাম্বুলেন্স দুটি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সি-অ্যাম্বুলেন্সটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে হারামিয়া ১০ শয্যা হাসপাতালের জঙ্গলের ভেতর। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া সি অ্যাম্বুলেন্সটি অযতেœ অবহেলায় পড়ে আছে গুপ্তছড়া ঘাটের কাছে ম্যানগ্রোভ বনের ভেতর।
উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য ২৫ লাখ টাকায় কেনা একটি সি-অ্যাম্বুলেন্স দিলেও তারা চালক ও জ্বালানির কোনো ব্যবস্থাই করেনি। তিন বছর অচল থাকার পর ২০১১ সালে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে অস্থায়ীভাবে একজন চালক ও জ্বালানি তেলের ব্যবস্থা করে সি-অ্যাম্বুলেন্সটি চালু করা হয়েছিল। প্রায় এক বছর চলার পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স¤্রাট খীসা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, একটি দুর্ঘটনার কারণে উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্যে সাময়িকভাবে স্পিডবোট বন্ধ রাখা হয়েছিল।
স্পিডবোট চলাচল বন্ধ থাকায় জরুরি মুহূর্তে সংকটাপন্ন রোগীকে চট্টগ্রাম নেওয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সার্ভিস বোট, মালবাহী বোটে রোগী পারাপার করা ছাড়া আপাতত অন্য কোন উপায় নেই।
চট্টগ্রাম স্বাস্থ্য উপ-পরিদর্শক ডাক্তার শাখাওয়াতউল্যা বলেন, কাঠের বোট, লাল বোট বা জাহাজে করে রোগী আনা অসম্ভব। কারণ একজন হার্টের রোগীকে দ্রুত চট্টগ্রাম না আনা গেলে রোগী বোটে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, এই নৌরুটে সি-অ্যাম্বুলেন্স চালানো সম্ভব হলেও একটি সি-অ্যাম্বুলেন্স চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ নৌ-রুটে যাতায়াতে সরকারি নির্ধারিত রিজার্ভ ভাড়া কিলোমিটার হারে প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা পড়বে। যা দ্বীপের গরিব মানুষের সাধ্যের বাইরে। জনগণের স্বার্থে উপজেলা প্রশাসন, এমপি মহোদয় এবং সন্দ্বীপ স্বাস্থ্য বিভাগ সহ বসে স্পিড বোটকে নিবন্ধনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করে দ্রুত চালু করা উচিত।
সূত্রমতে, চট্টগ্রামের সঙ্গে মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপের যোগাযোগের মাধ্যম বিআইডব্লিওটিএ-এর একটি জাহাজ। জাহাজ ছাড়াও সমুদ্রপথে যোগাযোগের জন্য রয়েছে ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকা (সার্ভিস বোট), পণ্যবাহী কাঠের নৌকা (মাল বোট), লাইফ বোট (লাল বোট) ও স্পিড বোট। দিনের বেলা এসব নৌযান যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করলেও সন্ধ্যার পর থেকে মূল ভূখ-ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে ওঠে দুঃসাধ্য। জাহাজ ও স্পিডবোট রাতে চলাচল না করায় সংকটাপন্ন রোগী পারাপার করতে হয় ইঞ্জিনচালিত লাইফবোট ও কাঠের নৌকার মাধ্যমে। দ্রুততম সময়ে সংকটাপন্ন রোগী পারাপার করার একমাত্র মাধ্যম অনুমোদনহীন স্পিডবোট। তাও পাওয়া যায় শুধু দিনের বেলায়।
এ ব্যাপারে সমাজকর্মী শামসুল আজম মুন্না বলেন, সার্ভিসবোট বা মালবাহী বোটে চট্টগ্রাম থেকে সন্দ্বীপ যেতে দেড় ঘন্টার বেশি সময় লাগে। জরুরি রোগী পারাপারের জন্য এটা কোন সঠিক ব্যবস্থা হতে পারে না। মুমূর্ষু রোগীর বেলায় এই দেড় ঘন্টা সময় অনেক মূল্যবান। চালক ও জ্বালানির ব্যবস্থাসহ সন্দ্বীপ চ্যানেলে চলাচলের উপযোগী দুটি সি অ্যাম্বুলেন্স দিতে হবে।
‘নিরাপদ নৌ-রুট চাই’ এর আন্দোলনকারী সদস্য ওমর ফয়সাল সন্দ্বীপবাসীর যাতায়াত এবং রোগী পারাপারের জন্যে নৌবাহিনীর ব্যবহৃত মেটাল শার্ক বোটের মত বোট দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
গত ২০ এপ্রিল সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে স্পিডবোট উল্টে মারা যায় ৪ শিশু। দুর্ঘটনার পরদিন ২১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌ-রুটে সার্ভে সনদ ও রুট পারমিটবিহীন স্পিডবোট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন। যে কারণে সঙ্কটাপন্ন রোগী পারাপারে অধিক সময় রোগীর মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে তুলেছে।
এ ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কেউ কেউ অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন স্বাস্থ্য বিভাগের দিকে, কেউ প্রশাসনের দিকে।
Discussion about this post