চট্টগ্রাস, ২৫ জুন, ২০২২:
দক্ষিণাঞ্চলের তথা দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষের বহু আকাক্সক্ষার, স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৬.১৫ কিমি দৈর্ঘ্যের এই সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছেন পদ্মা সেতুর দুই পাড়ের হাজার হাজার মানুষ। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আনন্দে এক পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে পদ্মা সেতুতে উঠে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। সেতুতে নয় সেতুর চারপাশে আনন্দ উদ্বেল মানুষ সকাল থেকে প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার আগে ভিড় করে সেখানে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পৌঁছান সকাল ৯ টা ৫৫ মিনিটে। সকাল ১০টা ৫ মিনিটে পদ্মা সেতুর থিম সং পরিবেশনের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সেখানে সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেন বেলা ১১ টায়। এর পর সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিটের উন্মোচন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু কন্যা সেতুর দিকে যান। গাড়িতে চড়ে টোল প্লাজায় গিয়ে সেতুর টোল পরিশোধ করেন। সেখান থেকে সেতুর উদ্বোধনী মঞ্চে। সেখানে দেশ ও জাতির জন্য মোনাজাত করেন। এরপর উদ্বোধনের মাহেন্দ্রক্ষণ। যে সময়টার দীর্ঘ সময় বাংলার মানুষের সাথে অপেক্ষায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তিনি সেতুর উদ্বোধনের নাম ফলক উন্মোচন করে সেতুর উদ্বোধন করেন। পৌনে ১২টায় মাওয়া পয়েন্টে টোল পরিশোধের পর ১২টায় উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচন করেন।
উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী ‘জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান দেন’। তার সঙ্গে থাকা সকলে সম্মিলিত কণ্ঠে সেই শ্লোগানের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি আকাশে ছড়িয়ে দেন। এই সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ জয়, সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইঞা।
প্রধানমন্ত্রী এক ফাঁকে তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে উদ্বোধনী ফলকের কাছে গিয়ে ছবিও তুলেন।
ম্যুরাল-১ উদ্বোধনের আগে নির্ধারিত মঞ্চে সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মঞ্চে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সাথে আসন গ্রহণ করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম স্বাগত বক্তব্য রাখেন। পরে বক্তব্য রাখেন সুধী সমাবেশ অনুষ্ঠানের সভাপতি সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
উদ্বোধনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা আবৃত্তি করে বলেন, ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ¦লে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মাথা নোয়াই নি, আমরা কোনদিন মাথা নোয়াব না, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও কখনও মাথা নোয়াননি, তিনি আমাদের মাথা নোয়াতে শেখান নাই, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন। তিনি বাংলার মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা চেয়েছিলেন এবং তারই নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা আরও বলেন, অনেক বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে এবং ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে আজকে আমরা এই পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছি। এই সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এই সেতু দুই পারের যে বন্ধন সৃষ্টি করেছে শুধু তাই নয়। এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহার কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহঙ্কার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ধসে পড়েনি। বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের কাছে আমরা প্রমাণ করেছি, ‘আমরাও পারি।’ পদ্মা সেতু তাই আত্মমর্যাদা ও বাঙালির সক্ষমতা প্রমাণের সেতু শুধু নয়, পুরো জাতিকে অপমান করার প্রতিশোধও। বাংলাদেশের জনগণই আমার সাহসের ঠিকানা।’
তিনি বলেন, এই সেতু বাংলাদেশের জনগণের। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের সাহসিকতা, সহনশীলতা আর আমাদের প্রত্যয় এবং এই জেদ যে, এই সেতু আমরা তৈরী করবোই। যদিও ষড়যন্ত্রের কারণে এই সেতুর নির্মাণ দুই বছর বিলম্বিত হয়। কিন্তু আমরা কখনো হতোদ্যম হইনি।
এরপর সেতু মাওয়া প্রান্ত থেকে শরিয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের দিকে রওনা হলে বিমানবাহিনীর একটি চৌকস দল আকাশে বর্ণিল মহড়া প্রদর্শন করে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানায়। এ সময় সেতুর উপর গাড়ি থামিয়ে প্রধানমন্ত্রী এই প্রদর্শনী উপভোগ করেন।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এই অনুষ্ঠানকে রঙিন করতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আবদুল হান্নানের নির্দেশে এক বর্ণিল ফ্লাইপাস্টের আয়োজন করা হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. মনিরুজ্জামান হাওলাদারের নেতৃত্বে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান, পরিবহন বিমান ও হেলিকপ্টারসহ ২৮টি উড়োজাহাজ এই ফ্লাইপাস্টে অংশ নেয়।
এরমধ্রে কয়েকটি বিমান উড্ডয়নের পাশাপাশি বর্ণিল ধোঁয়া ছেড়ে অনুষ্ঠানস্থল অতিক্রম করে। আর জাতীয় পতাকাকে সামনে রেখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি, উদ্বোধনকৃত পদ্মা সেতু ও জয় বাংলা ব্যানার নিয়ে এগিয়ে যায় পাঁচটি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার।মান উড্ডয়নের পাশাপাশি বর্ণিল ধোঁয়া ছেড়ে অনুষ্ঠানস্থল অতিক্রম করে। এ সময় জাতীয় পতাকাকে সামনে রেখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি, উদ্বোধনকৃত পদ্মা সেতু ও জয় বাংলা ব্যানার নিয়ে এগিয়ে যায় পাঁচটি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার।
বহুল কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু পার হয়ে তিনি পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-২ উন্মোচন করে আবারও মোনাজাতে অংশ নেন।
সেখান থেকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ির উদ্দেশ্যে সড়ক পথে যাত্রা করেন। দুপুরে কাঁঠালবাড়িতে আওয়ামী লীগের জনসভায় অংশ নেন।
জাজিরা প্রান্তে পৌঁছে পূর্ব নির্ধারিত জনসভায় তিনি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের উদ্দেশে বলেন, আর আপনাদের কষ্ট করতে হবে না। এই খরস্রোতা পদ্মা নদী পার হতে যেয়ে আর কাউকে সন্তান হারাতে হবে না, বাবা-মাকে, ভাই-বোনকে হারাতে হবে না। আজকে সেখানে আপনারা নির্বিঘেœ চলতে পারবেন। সেই ব্যবস্থা আমরা করে দিয়েছি।
সভায় তিনি দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন।
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য আজকের দিনটি ‘বিশেষ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই শরীয়তপুরে যখন এসেছি, তখন কী ছিল? লঞ্চে করে এসেছি, লঞ্চ নষ্ট হয়ে গেছে। নৌকায় করে একেকটা এলাকায় গিয়েছি, মিটিং করেছি। আজকে সেই শরীয়তপুরে অবস্থা পাল্টে গেছে।
দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে জনসভা শেষ করে শরীয়তপুরের জাজিরার সার্ভিস এরিয়া-২ এর উদ্দেশ্যে সড়কপথে যাত্রা করবেন। সেখানে কিছু সময় অবস্থান করবেন। পরে জাজিরা প্রান্ত থেকে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করবেন। সূত্র: বিভিন্ন জাতীয় সংবাদ মাধ্যম থেকে নেওয়া সংবাদের অংশ বিশেষ। ছবি: সংগৃহীত
Discussion about this post