চট্টগ্রাম, ২৪ আগস্ট, ২০২২:
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ ও পটিয়ার কাঞ্চন পেয়ারায় এখন চট্টগ্রামের বাজার ভরপুর। বাংলাদেশের আপেল হিসেবে খ্যাত কাঞ্চন পেয়ারা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। খেতে সুস্বাদু ও দেখতেও বেশ লোভনীয়। এই পেয়ারা উৎপাদনে কোনো সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। মানুষের ফলের চাহিদা মিটিয়ে এ পেয়ারার কদর এখন বিদেশেও। এই পেয়ারা যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন ও দুবাইসহ বেশ কয়েকটি দেশে। বদলে দিয়েছে হাজারো কৃষকের ভাগ্য। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ ও সংলগ্ন এলাকার পাহাড়-টিলায় কাঞ্চন পেয়ারার চাষ করে কৃষকরা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে, তেমনি কর্মসংস্থান হচ্ছে অসংখ্য স্থানীয় মানুষের। চন্দনাইশ উপজেলার শত শত পাহাড়ে বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হয় পেয়ারা।
মৌসুমে প্রতিদিন সকালে পেয়ারা পাহাড় থেকে তুলে এনে রাখা হয় চন্দনাইশে রাস্তার পাশে বিভিন্ন হাটে। এসব পেয়ারা নিয়ে হাটে কৃষক সারি সারিভাবে দাঁড়ায়। ক্রেতা এলেই চলে হাঁকডাক, জমে উঠে বিকিকিনি। তারপর চলে পাইকারি বেচাকেনা। চন্দনাইশের রৌশনহাট, গাছবাড়িয়া রেল স্টেশন, বাদামতল, খানহাট রেল স্টেশন, বাগিচাহাট এলাকায় চন্দনাইশের পেয়ারা। তবে চন্দনাইশ উপজেলার রওশন হাটে সবচেয়ে বেশি পেয়ারা বিক্রি হয়। চট্টগ্রামের পটিয়া ও চন্দনাইশের বিভিন্ন এলাকার হাটগুলোতে এমন দৃশ্য এখন নিত্যদিনের। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের আট-দশ কিলোমিটার এলাকার রাস্তার দুই পাশে অন্তত ১৬ জায়গায় ভোর থেকে বসে পেয়ারার হাট। আকার ও পরিমাণ অনুযায়ী এক একটি পেয়ারার ভার ১ হাজার থেকে ১৪’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান চাষীরা।
তবে পেয়ারা চাষীদের পেয়ারা বিক্রির জন্য কোন নির্দিষ্ট স্থান না থাকায় চাষীদের কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। আর পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য কোনো ব্যবস্থাও সেখানে গড়ে উঠেনি।
বংশ পরম্পরায় পেয়ারা চাষ ও বিক্রিতে নিয়োজিত পটিয়া, চন্দনাইশের অর্ধলক্ষ মানুষ। পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপাদিত এ পেয়ারা বেপারিদের হাত ঘুরে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ভোরেই বাগানগুলো হয়ে ওঠে সরব। পেয়ারা সংগ্রহে নেমে পড়েন শ্রমিকরা।
তবে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও অন্য দেশে এসব পেয়ারা রপ্তানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
কারণ চন্দনাইশের পেয়ারার অনন্য বৈশিষ্ট্য হল- যেমন মিষ্টি তেমনি বিচিও তুলনামূলক কম। পাকলে ভেতরে কোনোটি সাদা, কোনোটি হলুদ, কোনোটি লালচে। প্রতি মৌসুমেই বারি, বাউ, ইপসা, কাজী ও কাঞ্চনসহ ১৩ জাতের ছোট-বড়, সবুজ, আধা-পাকা পেয়ারার বাম্পার ফলন হয় চন্দনাইশের পাহাড়ি এলাকায়। প্রাকৃতিকভাবেই এই পেয়ারার বাম্পার ফলন হচ্ছে চন্দনাইশে যুগ যুগ ধরে। শুধুমাত্র বছরে একবার গাছের ডাল-পালা ছেঁটে দিয়েই বাগানের দায়িত্ব শেষ করা হয়। আর প্রয়োজন বৃষ্টি। চলতি মৌসুমে বৃষ্টি কম হওয়ায় পেয়ারার ফলন তেমন ভাল হয়নি বলে জানান চাষীরা।
সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাসে গাছে ফুল আসে। জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস পর্যন্ত বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করা যায়। চন্দনাইশের কাঞ্চন পেয়ারা সর্বোচ্চ ওজনে ১ কেজি ও সর্বনি¤œ ২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। পেয়ারা চাষীরা জানান, দেশে দুই জাতের পেয়ারা রয়েছে। একটি কাজী পেয়ারা আর অন্যটি কাঞ্চন পেয়ারা। কাজী পেয়ারা আকারে বড় হলেও স্বাদ একটু কম। অন্যদিকে কাঞ্চন পেয়ারার আকার ছোট হলেও স্বাদ ও পুষ্টিতে ভরপুর। একেকটি গাছ থেকে ৫০০ থেকে ৭০০ পেয়ারা পাওয়া যায়। প্রতি মৌসুমে দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বাগানে উৎপাদিত হয় ২০-৩০ কোটি টাকার পেয়ারা।
ভোরের আলো না ফুটতেই পাহাড় থেকে দল বেঁধে পেয়ারা নিয়ে বাজারে আসেন চাষীরা। লাল কাপড়ে মোড়ানো পুঁটলি বেঁধে আনা হচ্ছে তিন থেকে চার মাইল পথ পায়ে হেঁটে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন বিভিন্ন পয়েন্টে।
যেভাবে চন্দনাইশে শুরু হয়েছে পেয়ারা ফলন: এলাকার জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, ১৮৫০ সালের দিকে পটিয়ার কচুয়াই চা বাগানের মালিক হেগিন্স লন্ডন থেকে প্রথমে আনারস, পরে পেয়ারা ও লিচু বীজ এনে তার বাংলোর আশপাশে রোপণ করেন। পরে ওই বীজ থেকে চারদিকে বাগান ছড়িয়ে পড়ে। অন্য ফলের বাগান না টিকলেও টিকে যায় পেয়ারার বাগান। যা পরে এই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে কাঞ্চন পেয়ারা হিসাবে খ্যাতি পায়। চাষীরা বাণিজ্যিকভাবে এক পর্যায়ে চাষাবাদ শুরু করে।
কাঞ্চননগর এলাকার প্রবীণ বাগান মালিক আইয়ুব আলীর দাবি, ১৯৬০ সালের দিকে দক্ষিণ শ্রীমাই এলাকায় মাত্র ১০ একর জায়গায় পেয়ারা বাগান শুরু করেন তার বাবা মরহুম খলিলুর রহমান। ১৯৮০ সাল থেকে তিনিসহ তার ভাইয়েরা মিলে বাগান বাড়াতে থাকেন। বর্তমানে পাঁচ ভাইয়ের ৪০ একর পেয়ারা বাগান রয়েছে। পটিয়ার পাহাড়ি এলাকার হাইদগাঁও, কচুয়াই, খরনা, চন্দনাইশের কাঞ্চননগর, ছৈয়দাবাদ, লড এলাহাবাদ, ধোপছড়ি, কাঞ্চননগর, হাসিমপুর, জামিজুরী ও দোহাজারী এলাকার বিভিন্ন পাহাড়ে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষের পেয়ারা বাগান রয়েছে। যাদের আয়ের প্রধান উৎস হল এখন পেয়ারা চাষ।
চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রাণী সরকার সংবাদ মাধ্যমকে জানান, দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে পেয়ারা চাষ হচ্ছে। ছোট-বড় পেয়ারার বাগান আছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। এর মধ্যে চন্দনাইশের হাশিমপুর ও কাঞ্চননগরে আছে প্রায় ২ হাজার বাগান। এসব বাগানের মধ্যে কাঞ্চন নগরের পেয়ারা খুবই সুস্বাদু ও ঐতিহ্যবাহী পেয়ারা বা ‘গয়াম’ হিসেবে পরিচিত।
চাষীরা জানান, পেয়ারা বাগান থেকে বাজার পর্যন্ত ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় পেয়ারা আনা-নেয়া শ্রমিকদের জন্য কষ্টকর। এছাড়াও পেয়ারা চাষের সঙ্গে জড়িতদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সুদমুক্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করা হলে পেয়ারা চাষে আরো অনেকেই ঝুঁকে পড়বে। এতে বেকারত্ব দূর হবে। আর পেয়ারাবাগান এলাকায় ইটভাটা গড়ে উঠায় পেয়ারা চাষের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে চাষীরা শঙ্কা ব্যক্ত করেন।
Discussion about this post