চট্টগ্রাম, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২:
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বলপ্রয়োগে দেশত্যাগে বাধ্য করার পর একের এক বাংলাদেশের সাথে বৈরি আচরণ করছে মিয়ানমার। এর মধ্যে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা যারা মিয়ানমারের নাগরিক তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ। উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ৩৪টি ক্যাম্পে অবস্থান করছে তারা। এসব রোহিঙ্গাদের নেওয়ার নামগন্ধ নেই। কিন্তু মিয়ানমার নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
মাত্র পাঁচদিনের ব্যবধানে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মর্টার শেল ও যুদ্ধবিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ করেছে তারা। বাংলাদেশের সীমান্তের অভ্যন্তরে মর্টার শেল এসে পড়ার ঘটনায় বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানানোর ক’দিন না যেতেই যুদ্ধবিমান থেকে গোলা এসে আছড়ে পড়ল।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. এ কে আব্দুল মোমেন আজ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, তাদের বোম্ব আমাদের এখানে এসেছে। তবে শুক্রবার (২ সেপ্টেম্বর) যে বিমান সেটা আমাদের এখানে ঢুকেনি। তারপরও তাদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে বলেছি, তারা বলেছেন, এটা স্ট্রে বোম্ব। এটা আমাদের ওখানে নয়, বর্ডার ক্রস করেনি। সেগুলো জঙ্গল এলাকায় ফুটেছে, ‘সো, দিস ইজ এ গুড নিউজ’।
এদিকে গত ২ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি। এসময় হত্যা করা হয়েছে ১৯ পুলিশ কর্মকর্তাকে। এর জবাবে সীমান্ত এলাকায় বিমান হামলা শুরু করেছে মিয়ানমার জান্তা। সংবাদমাধ্যম ইরাবতী আরও জানায়, গত ৩১ আগস্ট মংডুর পুলিশ ফাঁড়িতে অতর্কিত হামলা চালায় আরকান আর্মির সশস্ত্র সদস্যরা। সেখানে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদসহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম জব্দের পাশাপাশি ১৯ জন জান্তা পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। এর জবাবে পরদিন সকালে যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার নিয়ে হামলা চালিয়েছে সামরিক বাহিনী। এর মধ্যে দুটি যুদ্ধবিমান ও একটি হেলিকপ্টার সকালে হামলা চালিয়েছে সীমান্ত এলাকায়। আর বিকেলে দু’টি জঙ্গি বিমান ও দু’টি হেলিকপ্টার থেকে বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। ওইদিন জান্তা সরকার জানায়, আরাকান আর্মির দখলে যাওয়া ফাঁড়িটি পুনরুদ্ধারে সেনা সদস্য এবং কামানের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
এর আগে গত ২ আগস্ট থেকে সীমান্ত এলাকায় হামলা জোরদার করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরকান আর্মি। এরপর থেকেই নতুন করে উত্তেজনা বেড়েছে অঞ্চলটিতে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্ত এলাকার অন্তত ছয়টি সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে আরাকান আর্মি। জবাবে বিমান ও হেলকিপ্টার নিয়ে প্রতিদিন তিন থেকে চারশ’ মর্টার শেল নিক্ষেপ করছে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। আতঙ্কে মংডু থেকে পালিয়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছেন অনেকে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে অভিজ্ঞরা সীমান্তে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক তৎপরতার সম্ভাব্য দুটি কারণ দেখছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে পুলিশ ফাঁড়িতে আরাকান আর্মির সর্বশেষ হামলার জবাবের পাশাপাশি নিজভূমে প্রত্যাবাসনের জন্য মুখিয়ে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক অব্যাহত রাখার কৌশল হিসেবে এই তৎপরতা চালানো হতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা গত ২৫ আগস্ট ক্যাম্পে জড়ো হয়ে নিজভূমে ফিরে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছে। বিষয়টা মিয়ানমারের জান্তা সবকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে থাকতে পারে। এ কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক জিইয়ে রাখার কৌশল হিসেবে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে গোলা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহম্মদ নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে গোলা বর্ষণ ও হেলিকপ্টার থেকে ফায়ারিংয়ের ঘটনার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের কৌশলকেই এগিয়ে রাখছেন। তিনি বলেন, ভীতি সঞ্চার করে প্রতিকূল পরিবেশে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিরুৎসাহিত করার কৌশল হিসেবে মিয়ানমারের সামরিক সরকার দেশের সীমান্তের অভ্যন্তরে যুদ্ধবিমান থেকে গোলা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি গোলা এসে বাংলাদেশের সীমান্তের অভ্যন্তরে পড়েছে। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ন’টায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় গোলা দুটি পড়ে।
আজ শনিবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, মিয়ানমার সীমান্তের ঘটনায় বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে আগামীকাল রবিবার তলব করা হবে। এ ঘটনায় তাদের কড়া প্রতিবাদ জানানো হবে। ছবি: সংগৃহীত
Discussion about this post