চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েক বর্গ কিমি. এলাকা জুড়ে বিধ্বস্ত জাহাজ, ট্রলার সহ নানা জলযান ধ্বংস হয়ে সাগরের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। আর ছিল ভয়াবহ মাইন। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম বন্দর নিমজ্জিত জাহাজ ও মাইন সরানোর জন্য বিশ্বের সাহায্য চেয়েছিলেন।
কারণ চট্টগ্রাম বন্দর অচল হয়ে পড়ায় খাদ্য, জ্বালানি, ঔধপত্র সহ নানা আমদানি পণ্যের অভাব দেখা তখন। সঙ্কট তৈরির সম্ভাবনাও ছিল। এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেয় কেবল সোভিয়েত সরকার।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দর বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যেমন তেমনি মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহার করেছে। এতে কর্ণফুলীর মোহনা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েক বর্গ কিমি. এলাকা জুড়ে বিধ্বস্ত জাহাজ, ট্রলার সহ নানা জলযান ধ্বংস হয়ে সাগরের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। আর ছিল ভয়াবহ মাইন।
তৎকালীন সোভিয়েত নৌবাহিনীর কর্মকর্তা রিয়ার এডমিরাল এসপি(সের্গিই পাভলভিচ) জুয়েনকো ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্ধারকারী জাহাজ ও মাইন উদ্ধারকারী দলের নেতা।
সেই ঘটনার স্মৃতিতে লেখা হয়েছে রিয়ার এডমিরাল এসপি(সের্গিই পাভলভিচ) জুয়েনকোর মনে রেখ আমাদের , হে বাংলাদেশ ’ গ্রন্থটি। জুয়েনকো নিজেই চট্টগ্রামে সোভিয়েত নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী নৌবহরের অধিনায়ক ছিলেন। ১৯৯৫ সালে বইটি রাশিয়ায় প্রকাশিত হয়। বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হয় রাশিয়া বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৪০ তম বছরে।
সের্গেই লিখেছেন, বন্দরের মুখে ও ডক ইয়ার্ডে আশেপাশে ডুবে যাওয়া জাহাজ অনেক ছিল। যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বন্দরে ৪০টির বেশি স্টিমার ও অন্যান্য নৌযান ডুবে গিয়েছিল। বন্দরের প্রবেশ পথ ডুবে যাওয়া জাহাজে অবরুদ্ধ ছিল। আর বন্দরের আশেপাশে বঙ্গোপসাগরের তলদেশ মাইনভর্তি ছিল। বন্দরে আসার পথে সাগরের ভেতরে পেতে রাখা হয়েছিল অসংখ্য মাইন।
তিনি লিখেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী ৮০টি বৈদ্যুতিক মাইন তখনো ভেসে বেড়াচ্ছিল। ৮০০ বর্গমাইল সাগর এলাকায় মাইনের উপস্থিতি ছিল।
সেগেই লিখেছেন, আমি ১৯ মার্চ আমি উদ্ধারকারী সেভিয়েত নৌবহরে অধিনায়ক নিযুক্ত হই। এবং চট্টগ্রাম বন্দরকে পুনর্জন্ম দেওয়ার যে কাজ সামনে অপেক্ষা করেছিল, তা ২ বছর তিন মাসে সম্পন্ন করি।
তাহলে কিভাবে তারা এই দুরুহ কাজটি সমাধান করেন এবং চট্টগ্রাম বন্দর সচল হয়েছিল। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে এসে সোভিয়েত দূতাবাসের অর্থ উপদেষ্টা নিকলাই আর্সেনিয়েভিচ ফিলচেনকোভ এর কাছ থেকে যুদ্ধে ধ্বংসের কিছু চিত্র পান সের্গেই। ‘ যুদ্ধটা স্বল্পকালীন হলেও খুব রক্তক্ষয়ী ছিল। হেরে যাচ্ছে বুঝতে পেরে পাকিস্তানীরা ব্রিজ কালভার্ট, রাস্তাঘাট, শিক্ষাকেন্দ্র, সব উড়িয়ে দিচ্ছিল। বিশেষ করে ক্ষতি হল- দেশের চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর। সেখানকার ধ্বংসযজ্ঞে ভূমিকা ছিল পাকিস্তানের ও ভারতের উভয় দেশের বিমানবাহিনীর। আর তা ছাড়া স্বয়ং বাঙালি মেরিন যোদ্ধারাও মাইন ফাটিয়ে জাহাজ ধ্বংস কম করেনি।
‘নৌবাহিনীর দুর্যোগ প্রতিরোধ টিম হিসাবে আমরা এর আগে ডুবন্ত জাহাজ উদ্ধার করেছি, আগুন নিভিয়েছি, মানুষের জীবন বাঁচিয়েছি, অল্প পানি থেকে গভীর পানিতে জাহাজ টেনে নিয়ে গেছি, কিন্তু এত বেশি সংখ্যক ডুবন্ত অচল জাহাজ আমরা এর আগে কোথাও দেখিনি।’
অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর কর্ণফুলি নদীর বৈশিষ্ট্যও তার জানা নেই। তিনি লিখেছেন, নদী ¯্রােতের সাথে বিপুল পরিমাণ পলিমাটি বয়ে নিয়ে আসে। জোয়ার ভাটার সমস্যায় ডুবুরিদের দৈনিক সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি কাজ করা সম্ভব ছিল না। এই সমস্যার মধ্যে -চল্লিশটির মত জাহাজ তুলতে হবে, কমপক্ষে এক হাজার বর্গ মাইল এলাকা মাইনমুক্ত করতে হবে। ভাঙ্গা জাহাজ টাগবোট সরিয়ে নিতে হবে।
তিনি বন্দর পর্যবেক্ষণকারী সোভিয়েত বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট পেলেন ৩০ মার্চ। এই বিশেষজ্ঞ টিমে ছিলেন সোভিয়েতের সকল সেরা সমুদ্র বিশেষজ্ঞরা।
তিনি লিখেছেন, ২৩, ২৫, ২৭ এপ্রিল বন্দর থেকে জাহাজ কাটার স্থানে সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টনবাহী তিনটি জাহাজ সরিয়ে ফেলা হল। ফলে প্রায় ৬০ মিটার মিলিত দৈর্ঘ্যরে তিনটি ঘাট অবমুক্ত হল।
যদিও- এ কাজ খুব সময় সাপেক্ষ ও জটিল ছিল। বিশেষ করে ভাষাগত সমস্যা ছিল, বাঙালি নৌযান আর ক্রুদের সাথে।
‘তিনটি জাহাজ টেনে নেবার সময় সহকারী নৌযান সমূহের কাফেলার দৈর্ঘ্য হয়েছিল ৩৫০ মিটার। সেগুলো সফলভাবে স্থানান্তরে প্রমাণ হল অন্তত ৩৫০ মিটার পর্যন্ত পথ নিরাপদ আছে। আর সব্বোর্চ ৫০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে জাহাজ এই পথে সহজে গমনাগমন করতে পারবে। তিনটি টার্মিনাল চালু হয়েছে, তিনটি বড় জাহাজ সরিয়ে ফেলায় অনেকটা মুক্ত হয়ে পড়েছে বন্দর। বলা যায় বন্দরের জীবন ফিরে এসেছে।
৭২ এর ২ মে থেকে মাইন সরানোর কাজ শুরু করে তারা। মে মাসের শুরুতে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে বঙ্গন্ধুর সামনে কাজের অগ্রগতির রিপোর্ট দিতে হয়েছে। তিনি লিখেছেন, রিপোর্টে বঙ্গন্ধুর মুখে হাসির আভাস দেখা গেল। ধন্যবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু সের্গেইকে জড়িয়ে ধরেন।
এভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের নৌবাহিনীর প্রায় ২ হাজার মেরিন সেনা ও কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের অক্লান্ত পরিশ্রমে চট্টগ্রাম বন্দর মাইনমুক্ত করে সচল করা হয়েছিল। আর নিমজ্জিত জাহাজ সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।
অথচ চট্টগ্রাম বন্দর সচল করার জন্য বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ইন্সুরেন্স কোম্পানি লয়েড ঘোষণা করেছিল- ঝুঁকিপূর্ণ চট্টগ্রাম বন্দরে যে সব জাহাজের মালিক তাদের জাহাজ চট্টগ্রাম পাঠাবে, তাদের বীমার পেমেন্ট ২৫% বাড়ানো হবে। তারপরও ঝুঁকি নিতে কেউই রাজি হয়নি। অন্যদিকে রাশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশও এগিয়ে আসেনি। এই সুযোগে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশগুলোর শিপিং কোম্পানির জাহাজ চট্টগ্রামকে পাশ কাটিয়ে তখন ভিড়ছে ভারতের নানা বন্দরে।
Discussion about this post