চট্টগ্রাম,২০ মে, ২০২৪:
হাসিনা শাসনের দীর্ঘ অধ্যায়ের অবসানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক নতুন পালাবদলের সূচনা করেছে। তা অর্থনৈতিক ও ভূকৌলশগত রাজনীতির অংশ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তোলপাড় চলছে। রাজনৈতিক মেরুকরণও ঘটছে।
এ পালাবদলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম বন্দর।যা বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বাণিজ্যিক প্রবেশদ্বার এবং বঙ্গোপসাগরীয় ভূ-কৌশলগত রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটেল ফিল্ড।
চট্টগ্রাম বনদরের নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনার বিদেশি কোম্পানিকে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার সরকারি উদ্যোগের মধ্যে দেশি বিদেশি রাজনীতিতে আলোচনা- সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপি- জামায়াত সহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এনসিটি(নিউ মুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল) বিদেশি কোম্পানির পরিচালনায় দিতে তীব্র বিরোধিতা করছে।
হাসিনা রেজিমের আমলে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব যেমন ক্রমশ বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বন্দরের সক্ষমতাও। কিন্তু রেজিম পতনের পর এই বন্দরের ভবিষ্যত নিয়ে যে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তা শুধু বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কারণে নয় তা বরং ভূ-রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ, ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এবং ভারত মহাসাগরীয় নিরাপত্তা কাঠামোর কারণে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এনসিটি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়া:
চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে ষড়যন্ত্রের আভাসের কারণ
New Mooring Container Terminal (NCT)। এটি চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে আধুনিক এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কনটেইনার টার্মিনাল। যাকে আরো সক্ষম করে তোলা যায় বলে সরকার বলছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস ১৪ মে বলেছেন, সরকার চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশ্বমানের বন্দরে রূপান্তরের জন্য এর ব্যবস্থাপনা বৈশ্বিক পরিচালকদের কাছে অর্পণ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
ওইদিন প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অপারেটরদের কাছে বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তরের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আমি আশা করি সবাই এর বাস্তবতা উপলব্ধি করবে।’
এরমধ্যে রাজনৈতিক বিতর্কে বিএনপি ও জামায়াত এটি বিদেশিদের হাতে দেওয়ার বিরোধিতা করছে। রাষ্ট্রচিন্তক ফরহাদ মজহার বলছেন, রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নীতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের সামরিক গুরুত্ব অপরিসীম।
কিন্তু NCT-এর ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কোনো বিদেশি অপারেটরকে যুক্ত করার সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি হলো—
আন্তর্জাতিক মানের পরিচালনার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর ও টার্মিনালের দক্ষতা বাড়ানো। পণ্য পরিবহনের সময় ও খরচ কমানো। বিদেশি বিনিয়োগের আস্থা তৈরি করা। বন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে গড়ে তোলা।
বিশ্বব্যাপী এমন উদাহরণ আছে—যেখানে আধুনিক বন্দরসমূহ বিদেশি কনসোর্টিয়াম দ্বারা দক্ষভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যেমন কলম্বো, দুবাই, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি।
কিন্তু রাজনৈতিক বিরোধ হচ্ছে- কিছু রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে, বন্দরের শ্রমিক সংগঠনগুলোও আন্দোলনে নেমে পড়েছে। দেশের বিশিষ্টজনদের অনেকেই বলছেন, বিদেশি অপারেটরের নিয়ন্ত্রণে গেলে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। দেশীয় শ্রমিকদের নিয়োগ ও স্বার্থ উপেক্ষিত হতে পারে। বন্দরের অভ্যন্তরীণ তথ্য বিদেশি সংস্থার হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। রাজনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দেয়নি সরকার।
সরকারি যুক্তি: সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদেশি অপারেটর “মালিক নয়, কেবল অপারেটর” হিসেবে কাজ করবে এবং সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে বন্দরের প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনেই। এই যৌথ ব্যবস্থাপনা দেশের স্বার্থের পরিপন্থী নয় বরং দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হতে পারে।
বিদেশি অপারেটর কারা: এখন পর্যন্ত আলোচনায় আছে- দুবাইয়ের DP World।
কিন্তু এনসিটি-এর ভবিষ্যত শুধু অর্থনৈতিক প্রশ্ন নয়, তা হয়ে উঠেছে এক জটিল কূটনৈতিক চিত্রের প্রতিফলন।
সরকার যে বিষয়টা সমনে আনছে- বাংলাদেশ কি আধুনিকতার পথে পা রাখবে নাকি জাতীয়তাবাদের সুরক্ষায় কিছুটা পেছনে থাকবে? এই প্রশ্ন এখন শুধু রাজনৈতিক বিতর্ক নয়, বরং রাষ্ট্রীয় কৌশল নির্ধারণের কেন্দ্রীয় উপাদানও।
চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিমের মধ্যে সংযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বাংলাদেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯০% পরিচালিত হয় এই বন্দর দিয়ে। শুধু তাই নয়, ভারত ও নেপালের নর্থ-ইস্ট অঞ্চলের জন্য ট্রানজিট সুবিধা, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) সংক্রান্ত আগ্রহ, এবং যুক্তরাষ্ট্রের Indo-Pacific কৌশলের কারণে চট্টগ্রাম এখন এক বহুমাত্রিক আগ্রহের কেন্দ্র।