চট্টগ্রাম, ১৯ মে, ২০২৫:
#লেখাটি রাষ্ট্রচিন্তক কবি ও লেখক ফরহাদ মজহারের ফেসবুক থেকে নেওয়া–
১. জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে দেশে বিদ্যমান ইন্টারনেট–সেবার মানোন্নয়নের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা না নিয়ে এলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা বাংলাদেশে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করে সবকিছু স্বচ্ছ ও জনগণের জবাবাদিহিতার অধীনে আনার জন্য। কেন? যেন বাংলাদেশের জনগণ প্রযুক্তিগত জ্ঞান দ্রুত আয়ত্ব করতে পারে, প্রযুক্তির স্থানান্তর দ্রুত ও ত্বরান্বিত হয়, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি দ্রুততর হয়, সর্বোপরি নিজেরা আবিষ্কার করবার অবকাঠামগত পরিবেশ এবং বিজ্ঞান চর্চার ভিত্তি দ্রুত তৈরি হয়, ইত্যাদি।
কিন্তু জনগণ দেখছে, ড. ইউনূস জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেবার আইনী ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ না নিয়ে রাষ্ট্রকে আবারও পুরানা ফ্যাসিস্ট সংবিধান এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে বেঁধে ফেললেন। সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের কোন পদক্ষেপ তিনি নিলেন না। অথচ ক্ষমতা পেয়েই বাংলাদেশের জনগণকে ক্ষমতাবান না করে সব কিছু ‘আউটসোর্সিং’ করতে শুরু করে দিয়েছেন।
তাঁর উচিত ছিল আমাদের অর্থনৈতিক বিকাশের বাধা ও চ্যালেঞ্জ এবং দীর্ঘ ফ্যাসিস্ট ও আমলাতান্ত্রিক শাসনের ফলে সৃষ্ট গভীর ক্ষত ও সংকটগুলো আগে শনাক্ত করা। দরকার ছিল অল্প কয়েকটি বহুজাতিক কর্পোরেশান ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর বিপরীতে বাংলাদেশকে শক্তিশালী করবার পথ আগে অনুসন্ধান করা। আন্তর্জাতিক শোষণের কাছাখোলা ময়দান থেকে পোস্ট-কলোনিয়াল বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে বের হয়ে আসার নীতি ও কৌশল নির্ণয় করা। জনগণের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের কাছ থেকে সম্মতি আদায়ের প্রক্রিয়া শুরু ও শেষ করা। তিনি তা করছেন না। এতে জনগণ মনে করতে শুরু করেছে তিনিও চরম একনায়কতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার মতো একাই সব সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছেন।
২. চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার দ্বারা শৃংখলিত। চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা ও অর্থনৈতিক নীতিত দুর্ডশায় আক্রান্ত। বিশেষত মাফিয়া ও লুটেরা শ্রেণীর লুটপাটের জাল থেকে মুক্ত নয়। অথচ তার কথায় মনে হয় বন্দর বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন মাল খালাস করবার জেটি বা টার্মিনাল মাত্র। আসল কাজ থুয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে চট্টগ্রাম বন্দর নামক হৃদপিণ্ডের অসুখ বড় ‘ডাক্তার’ দিয়ে চিকিৎসা করতে চান। বড় বড় বহুজাতিক কোম্পনী নাকি কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ‘হৃদপিণ্ড’ বানিয়ে দেবে। তাঁর মতো একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মানুষ এই সকল হাস্যকর যুক্তি দিয়ে বন্দর আউটসোর্সিং করবার নীতি আরোপ করবার কথা বলছেন। আমরা লজ্জিত।
বন্দর ব্যবস্থাপনা আউটসোর্সিং-এর উদাহরণ হিশাবে যেসব দেশের ফিরিস্তি দেওয়া হচ্ছে সেই সকল দেশ সবার আগে তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠমো ঠিক করেছে। অনেকে পূর্ণ রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গিয়েছে যেন জনগণ নিজেদের স্বার্থের দিক নিজেরা রক্ষা করতে পারে। তারা বন্দর ইজারা দিয়েছে বটে কিন্তু নিজেদের রাষ্ট্রীয় ভাবে গঠন বা নিদেন পক্ষে সংস্কারের কাজ আগে করেছে। সর্বোপরি জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেছে। এমনকি টেকনোলজি ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ট্রান্সফার এবং কর্মসংস্থানের নীতিও তারা আগে প্রণয়ন করেছে।
ড. ইউনূস তো কর্মসংস্থানের নীতিতে বিশ্বাস করেন না। তিনি ঘোষণা করেছেন, কেউ যেন ‘জব’ বা চাকরি না খোঁজে, সবাই শুধু ব্যবসা করুক। ড. ইউসূসকে বলব, আসুন, আগের কাজ আগে করি। তারা আগে বিপ্লব কিম্বা রাষ্ট্রের সংস্কার করেছে। অথচ আমরা এতো বড় গণ অভ্যুত্থানের পরও রাষ্ট্রের কোথাও কোন আঁচড় লাগাতে পার নি। শেখ হাসিনার সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছি এবং চরম দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছি।
ড. ইউনূস বাংলাদেশকে আগে নতুন ভাবে গঠনের কাজ করছেন না। বিপরীতে তিনি বিদ্যমান বিশ্ব বাজারের খোলা ময়দানে বাংলাদেশকে বড় বড় কোম্পানি ও বৈশ্বিক মহাজনদের কাছে বেচাবিক্রি শুরু করে দিয়েছেন। জনগণ এর জন্য শহিদ হয় নি কিম্বা সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে নি। বাংলাদেশের সামষ্টিক উন্নতির কোন সুস্পষ্ট নীতিমালা ছাড়া কাছাখোলা কায়দায় বিদেশী কর্পোরেট স্বার্থের কাছে বন্দর সহ বিভিন্ন অবকাঠামো ছেড়ে দেওয়া মোটেও ঠিক নয়। বাংলাদেশের স্বার্থ কোথায় আগে সে বিষয়ে জনগণকে কথা বলতে দিন, সামষ্টিক স্বার্থের কথা বলুন। আউটসোর্সিং করলে জনগণের কি উপকার তা সঠিক পরিসংখ্যান ও তথ্যের ভিত্তিতে প্রমাণ করুন।
৩. তার দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে যে মতাদর্শিক কারণ বা অন্ধ বিশ্বাস কাজ করে সেটা হোল বাংলাদেশের জনগণের ক্ষমতা ও সম্ভাবনায় গভীর অবিশ্বাস। ড. ইউনূস আসলেই বিশ্বাস করেন বাংলাদেশের কোন ‘হৃদপিণ্ড’ নাই। থাকলেও সেটা হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। কিন্তু সেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া এখন বন্ধ। হার্টফেলের জোগাড়। আমরা হৃদপিণ্ডের অসুখে ভুগছি , অতএব বিদেশ থেকে বড় বড় ডাক্তার এনে আমাদের হৃদপিণ্ডের চিকিৎসা করতে হবে আগে। চটগ্রাম বন্দর নিয়ে তাঁর হৃদপিণ্ড স্টোরি আমাদের চরমভাবে হতাশ করেছে।
আমরা মনে করি বন্দর ব্যবস্থাপনাকে অবশ্যই দক্ষ করে তুলতে হবে। এই ক্ষেত্রে তাঁর সাথে আমরা একমত। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে শুধু বাংলাদেশ নয়, উত্তরপূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও জড়িত। তাঁর এই দাবির সাথেও আমরা একমত। তাহলে সবার আগে বন্দর অব্যবস্থাপনার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে জনগণকে সেটা জানাতে হবে। তিনি সেটা করেন নি। শুধু তাই না। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবার জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছেন। এতে তাঁর ভাবমূর্তি মারাত্মক ভাবে ক্ষুণ্ণ হবে।
জুলাই গণ অভ্যুত্থান হয়েছে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে আনার জন্য। স্রেফ ‘রেজিম চেইঞ্জ’-এর জন্য নয়। রক্ত দিয়ে যারা বাংলাদেশ মুক্ত করেছে তাদের কোন কিছু না জানিয়ে কোন তর্কবিতর্ক আলাপ আলোচনা ছাড়া বন্দর ইজারা দেওয়া জুলাই গণঅভ্যুত্থনের স্পিরিটের সম্পূর্ণ বিরোধী। চরম দুর্নীতিবাজ ফ্যাসিস্ট সরকারের দুর্নীতির নতুন পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রাম বন্দর ইজারা দেওয়া, ফ্যাসিস্ট শক্তিকে আমরা উৎখাত করেছি, কিন্তু তার ভূত এসে আমাদের মাথায় চেপে বসেছে।
৪. আমাদের কোন জাতীয় বন্দর নীতিমালা নাই। জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের সামরিক গুরুত্ব অপরিসীম। ভুরাজনৈতিক বিপদ সম্পর্কে কোন অর্থপূর্ণ জাতীয় আলোচনা নাই। গণসম্মতি এবং জবাবাদিহিতার ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোন ব্যবস্থা নাই। এই বাস্তবতায় চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশী কর্পোরেট স্বার্থের হাতে ছেড়ে দেওয়া গণস্বার্থ বিরোধী কাজ হবে।
বলাবাহুল্য চট্টগ্রাম বন্দর শুধু অর্থনৈতিক ইস্যু না, একই সঙ্গে সামরিক ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। তাছাড়া চট্টগ্রামকে বঙ্গোপসাগর ও তিন নদীর মোহনায় বিশ্বসেরা বঙ্গোপসাগরীয় বন্দর-শহর হিশাবে গড়ে তুলতে হলে আমাদের প্রচুর কাজ আগাম সম্পন্ন করে আসতে হবে। জুলাই গণভ্যুত্থান আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
এই সুযোগ আমরা হেলায় হারাতে চাই না।
৫. চট্টগ্রাম বন্দরে অদক্ষতার জন্য প্রধানত কাস্টমস দায়ী – অর্থাৎ রাজস্ব বিভাগের আমলা এবং বন্দরের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা দায় এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী। জাহাজ থেকে মাল ওঠানামার ক্ষেত্রে যে সময়ের দরকার সেই সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। ইতোমধ্যেই বন্দর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দক্ষতা প্রচুর বেড়েছে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিপুল গণপ্রেরণাও সৃষ্টি করেছে। এই ক্ষেত্রে অবশ্যই বন্দর শ্রমিকদের অবদান রয়েছে। কাস্টমস ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করলে বাংলাদেশই বিশ্বের সেরা বন্দর ব্যবস্থাপনার প্রমাণ দিতে সক্ষম। কিন্তু বিগত ফ্যাসিস্ট শক্তির আমলে সেটা করতে দেওয়া হয় নি। তাহলে ড. ইউনূস কি ফ্যাসিস্ট শক্তির পদাংকই অনুসরণ করতে চাইছেন?
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা আউটসোর্সিং হলে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা অর্জনের প্রক্রিয়া মারাত্মক বিঘ্নিত হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরে সেটা হবে বাংলাদেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে নির্বিচারে বিদেশী কর্পোরেট স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো। স্বচ্ছ আলোচনা পরিহার, জনমত উপেক্ষা করা এবং বিদেশী বন্দর অপারেটর মানেই ভাল— এই ভূয়া দাবির ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশী অপারেটরদের হাতে তুলে দেওয়া কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।