#প্রান্তিক দাশ
চট্টগ্রাম, ১৮ নভেম্বর, ২০২২: বঙ্গোপসাগরে উপকূলেই বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বপ্নদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর। যেটি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়াও মংলা সমুদ্র বন্দর, পায়রা সমুদ্র বন্দরও বঙ্গোপসাগরের উপকূলে। এছাড়া নির্মাণ করা হচ্ছে মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্র বন্দর। এসব বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দিন দিন আরো সমৃদ্ধ করে তুলছে।
কিন্তু এর বাইরেও বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। ভারত মহাসাগরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শাখা বা উপসাগর হচ্ছে বঙ্গোপসাগর।
মিষ্টি পানির অমিত প্রাচুর্য্য বঙ্গোপসাগরের একটি বড় বৈশিষ্ট্য। এর বুকে বছরে ১.৬ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার মিষ্টি পানির প্রবাহ উগরে দিচ্ছে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনাসহ বিশ্বের বৃহত্তম কয়েকটি নদী। ভূপৃষ্ঠের অন্যান্য সাগরে গড় লবণাক্ততার পরিমাণ যেখানে ৩৫ পিপিটি, সেখানে আমাদের প্রাচীন প্রতিবেশি এ উপসাগরে তার মাত্রা উপকূলীয় এলাকায় ‘শূন্য’ থেকে আরম্ভ করে সর্বোচ্চ ৩০ পিপিটি মাত্র। অন্যদিকে হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীখাতসমূহ প্রায় খাড়া ঢাল বেয়ে আসার ফলে এসব নদীস্রোতের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে জমা হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পলিভাণ্ডার।
পৃথিবীর অন্যান্য সাগরের তুলনায় বঙ্গোপসাগরের স্রোতধারার রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। গ্রীষ্মমৌসুমে এর গতিমুখ থাকে ঘড়ির কাঁটার অভিমুখে এবং শীতকালে তা আবর্তিত ঘড়ির কাঁটার বিপরীত মুখে।
বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ৬৪টি জীববৈচিত্র্য এলাকার অন্যতম বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরের অগভীর এলাকায় ১০০-২০০ মিটার প্রায় পুরোটাই অক্সিজেন সমৃদ্ধ যা এই পরিবেশ উপযোগী জীববৈচিত্র্যের অনুকূল।
এখানে পাওয়া যায় কেরিলিয়া জারদোনি নামের এক বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক সাপ। আরও আছে ব্রাইডস হোয়েল নামে এক প্রকার তিমি। আছে হলুদ ডানার টিউনা, কুঁজঅলা ডলফিন এবং ব্রাইডহোয়েল জাতের তিমি।
এর উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে ৪৫৩ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী জীব, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ বা রেপটাইল এবং ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী। যদিও এর একটা বিরাট অংশই রয়েছে বিপন্ন হবার ঝুঁকির মাঝে। উপকূলীয় অঞ্চলে গবেষণা চালিয়ে মোহনায় পাওয়া গেছে ৩০১ প্রজাতির মোলাস্ক (অমেরুদণ্ডী শামুক, ঝিনুক, অক্টোপাস জাতীয়), বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক ৫০ প্রজাতির চিংড়িজাতীয় প্রাণী এবং ৭৬ প্রজাতির মাছ।
বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রভুবনে আরও আছে ৪৪২ প্রজাতির মাছ এবং ৩৬ প্রজাতির সামুদ্রিক চিংড়ি জাতীয় প্রাণী। সনাক্ত করা হয়েছে ১৫১ গোত্রের ৩৩৬ প্রজাতির ঝিনুক-শঙ্খ জাতীয় জীব। এর সমুদ্রসীমায় বসবাস করছে ৩ প্রকার লবস্টার এবং ৭ প্রজাতির কূর্ম ও কচ্ছপ, ১৬৮ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ৩ প্রকার স্পঞ্জ, ১৬ প্রজাতির কাঁকড়া, ১০ প্রজাতির ব্যাঙ, ৩ প্রকার কুমির, ২৪ প্রজাতির সাপ, ৩ প্রজাতির ভোঁদড়, এক প্রকার সজারু, ৯ প্রজাতির ডলফিন এবং ৩ প্রজাতির তিমি।
কেবল সেন্ট মার্টিন দ্বীপেই সনাক্ত করা হয়েছে ২৩৪ প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে প্রবালজাতীয় রয়েছে ৯৮টি প্রজাতি।
বঙ্গোপসাগরে উপকূলীয় অঞ্চলের একটা বড় অংশ জুড়ে গড়ে উঠেছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এসব বনাঞ্চলের মধ্যে রয়েছে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন। বরিশাল, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম আর কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলের বনাঞ্চল এই হিসেবের মধ্যে নিলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের পরিমাণটি দাঁড়ায় দেশের মোট বনাঞ্চলের প্রায় অর্ধেক।
বিগত চার দশক কিংবা তারও বেশি সময় ধরে চিংড়ি চাষ বড় ধরনের অবদান রাখছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ছয় লাখ মানুষ সরাসরি জড়িত রয়েছে এই শিল্পে।
দেশের স্থলভাগের আয়তন ১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৪ বর্গকিলোমিটার। পক্ষান্তরে আমাদের সমুদ্র এলাকার আয়তন ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার। এর উত্তর, পশ্চিম আর উত্তর-পশ্চিমে ভারত, পূর্বে আর দক্ষিণপূর্বে মায়ানমার আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
বঙ্গোপসাগরের মোট আয়তন ২১ লাখ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং এর গড় গভীরতা ২৬০০ মিটার, বা কমবেশি আড়াই কিলোমিটার। উপসাগরের সঙ্গে আমাদের উপকূলরেখার দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগরের আমাদের সমুদ্রঅঞ্চলে গড়ে ৫০ মিটার গভীরতার কনটিনেন্টাল শেলফের আয়তন ৩৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। এটি বর্তমানে আমাদের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন, বা একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।
বঙ্গোপসাগরে জেলেদের হাতে ধরা পড়া মৎসসম্পদের পরিমাণ ২০১২-১৩ সালে ছিল ৫৮৮,৯৮৮ টন। এর বছর দশেক আগে পরিমাণটি ছিল ৩৭৯,৪৯৭ টন। এ মৎসসম্পদের অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত হিমায়িত আকারে রফতানি হয়ে যায় বিদেশে এবং বিশ্বের বড় বড় শহরে। বঙ্গোপসাগরে আহরিত এসব মাছের মধ্যে সবচেয়ে অর্থকরী এবং জনপ্রিয় মাছের নাম ইলিশ। প্রতিবছর জেলেদের জালে ধরা পড়ছে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান এবং উপার্জন ঘটছে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের। প্রতিবছর জাতীয় পর্যায়ে এ থেকে আয়ের পরিমাণ ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যতো ইলিশ আহরণ করা হয় তার ৫০-৬০ শতাংশই আসছে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর এলাকা থেকে। এগুলোর পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে রয়েছে বাগদা চিংড়ি আর গলদা চিংড়ির বিশাল সম্ভাবনা। ২০১২-১৩ সালে বঙ্গোপসাগর থেকে আহরণ করা হয় ৪৬ হাজার ৫৬৮ মেট্রিক টন বাগদা চিংড়ি যার শেষ গন্তব্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর জাপানের বাজার। এভাবে বঙ্গোপসাগর আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট ভুমিকা রাখছে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের সম্পদের অধিকাংশই আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
Discussion about this post