চট্টগ্রাম, ২৯ নভেম্বর, ২০২২:
ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি, অর্থ পাচার ও আত্মসাতের মামলায় দেশের উচ্চ আদালত বার বার ক্ষোভ উষ্মা প্রকাশ করছেন। ২৮ নভেম্বর (২০২২)বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছেন, দুদক কেন নীরব? কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাবে, দুদক চেয়ে চেয়ে দেখবে? তদন্ত শেষ করতে দেরি হচ্ছে কেন? তাদের কাজ করতে হবে।বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে করা পৃথক তিন মামলায় এক আসামির জামিন প্রশ্নে রুল শুনানিতে হাইকোর্ট এসব কথা বলেন।
এর আগে গত ৮ নভেম্বর একই মামলার শুনানিকালে আদালত অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছিলেন, যারা দেশের অর্থ পাচার করে, যারা ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের আমানতের টাকা লুট করে তাদের ‘গুলি’ (শুট ডাউন) করা উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। ওইদিন বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের দ্বৈত হাইকোর্ট বেঞ্চ আরো বলেছিলেন,অর্থ পাচারকারীরা দেশ ও জাতির শত্রু। এদের দুর্নীতির কারণে দেশ এগিয়ে যেতে পারছে না। এদের বিরুদ্ধে সামারি ট্রায়াল পরিচালনা করা দরকার।কারণ দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর হলো। এখন অর্থ পাচারকারী ও ব্যাংক লুটপাটকারীদের কাছে কি দেশের জনগণ পরাজিত হয়ে যাবে। এটা কখনোই হতে দেওয়া যাবে না।
গত ২০ এপ্রিল হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ বেসিক ব্যাংকের ৫৬ মামলার তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করতে দুদককে নির্দেশ দেয়। এজন্য ছয় মাস সময়ও দেওয়া হয়। গত ৮ নভেম্বর মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। কিন্তু দুদকের পক্ষে তদন্তের কোনো অগ্রগতি আদালতে দাখিল করা সম্ভব হয়নি।
এরপর ২৮ নভেম্বরে মামলার শুনানিতে হাইকোর্ট আবার অসন্তোষ প্রকাশ করে আরো বলেছেন, বিস্ময় প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেছেন, এতো জাস্ট লাইক এ ড্রামা (এতো নাটক ছাড়া কিছুই না)। যেমন নাটক দেখে হাততালি দেবেন নয়ত চুপচাপ বসে থাকবেন, এখানে বিষয়টা সেরকমই।’
আদালত আরো বলেন, সাত বছরেও তদন্ত শেষ হলো না? বলা হচ্ছে, প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়া বেশ জটিল, সব আলামত শনাক্ত করা সময়সাধ্য ও সাক্ষীদের আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কথাগুলো আপত্তিকর। দুদক যদি এসব কথা বলে, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
উল্লেখ্য,বেসিক ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ৫৬টি মামলা করে দুদক, যেখানে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। এর আগে ২৭ নভেম্বরশাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির মামলায় ব্যাংকটির সাবেক কর্মকর্তা এ এস এম হাসানুল কবিরের জামিন বাতিল চেয়ে আবেদনের শুনানিতে
হাইকোর্ট বলেছেন, রাঘব-বোয়াল রেখে চুনোপুঁটি ধরায় ব্যস্ত দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির মামলাটি ২০১৩ সালে করা হয়। কিন্তু এতদিনেও মামলাটির তদন্ত শেষ না হওয়ায় হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের দ্বৈত বেঞ্চ
দুদককে উদ্দেশ করে বলেন, ঋণখেলাপিরা আইনের চেয়ে শক্তিশালী নয়। তাহলে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছে, আপনারা (দুদক) ধরছেন না কেন? যারা বড় বড় ঋণখেলাপি তারা কি বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবে? যারা অর্থশালী তারা কি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে?
অবশ্য ২২ নভেম্বর, সোমবার দুদকের ১৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) জহুরুল হক বলেছেন, কেবল চুনোপুঁটিই ধরে না দুদক, বিশ্ব রেকর্ড করার মতো রাঘববোয়ালদেরকে ধরেছে। আপনারা বলেন, দুদক কেবল চুনোপুঁটি ধরে। কিন্তু দুদক বিশ্ব রেকর্ড করার মতো রাঘববোয়াল ধরেছে।
জহুরুল হক আরো বলেন, দুদকই পৃথিবীর একমাত্র সংস্থা যে দুর্নীতির দায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। অনেককে জেলেও পাঠিয়েছে, যা বিশ্বে অন্য কোনো দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা করেনি।
এই মত বিনিময় সভায় দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেছেন,
যেসব দেশে টাকা পাচার হয়, সেসব দেশের সঙ্গে যাতে দুদক সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে, সেই আইন করতে হবে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করে সাতটা প্রতিষ্ঠান। আমরা করি এই সাত ভাগের এক ভাগ। তারপরও আমরা অর্থ পাচার ঠেকাতে কাজ করছি। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়াটাও দীর্ঘ। বিভিন্ন মাধ্যমে যেতে হয়।
দুদকের চেয়ারম্যান বলেন, ‘মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগের বোঝা আমাদের নিতে হচ্ছে। অথচ এটা আমাদের শিডিউলেই নাই। আমাদের কাছ থেকে এটা নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে কাজের ক্ষমতা এখন দুদকের নাই। আবার অর্থ পাচারের তথ্য পেতে হলে আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা নিতে হয়।
বাংলাদেশে ব্যাংকের টাকা উধাও হয়ে যাওয়া অনেকটা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যেখানে এসব ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে মানুষের নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ রয়েছে। যেখানে দীর্ঘসূত্রিতা একটা বড় বিষয়।
ব্যাংকের অর্থ কেলেঙ্কারির প্রথম ঘটনা সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি। এলপর এই রাহাজানি আরো বাড়ে।
একে একে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জনতা ও প্রাইম ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের অনিয়ম, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ অনিয়ম। এ ছাড়া আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম, ইউনিয়ন ব্যাংকের বেনামি ঋণ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ঘটনা। আবার ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের ঘটনাও বেশ আলোচিত।
যেখানে ২০১১ সালে হলমার্কসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (হোটেল শেরাটন) শাখা থেকে ঋণের নামে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। বিচার চলছে তো চলছেই। টাকাও আদায় হয়নি।
বেসিক ব্যাংকের ঘটনা ঘটে ২০১১-১২ সালে।
২০১২-১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপ জনতা, প্রাইম, যমুনা, প্রিমিয়ার ও শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।
অ্যাননটেক্স গ্রুপের মালিক ইউনুস বাদলকে জনতা ব্যাংক ৬ বছরে তারা দেয় ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ দেয়। যার বড় অংশই এখন খেলাপি।
এরপর ভুয়া নথিপত্র তৈরি করে ক্রিসেন্ট গ্রুপ ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা নিয়েছে সরকারের নগদ সহায়তা তহবিল থেকে। এই টাকা সহ জনতা ব্যাংক ক্রিসেন্ট গ্রুপের কাছে পাবে২ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। রপ্তানির ১ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা আটকা রয়েছে। এ ঘটনায় কারও বিচার হয়নি বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে।
বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক নামধারী ফার্মাস ব্যাংক শুরু হয় অর্থ কেলেঙ্কারি দিয়ে। ৫০ কোটির বেশি টাকা লোকসান ছিল এই ব্যাংকে। তারা গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় তখন।
এর মধ্যে ইউনিয়ন ব্যাংকও ছিল নতুন ব্যাংক। এই ব্যাংক থেকে নামে বেনামে তিনশ প্রতিষ্ঠান নেওয়া প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা এখন খেলাপি।
অন্যদিকে সোশ্যাল ইসলামি ব্যাংকের ৫ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হওয়ার যোগ্য বলে ২০২১ সালে পরিদর্শন করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে। এটির খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ সাত হাজার ২৯৯ কোটি টাকা।
এছাড়া অনিয়ম ও নানা সঙ্কটে দিন পার করছে ন্যাশনাল ব্যাংক।
অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকেও ঘটেছে একের পর এক আর্থিক অপরাধ।
এভাবে বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে নানা উপায়ে। তথ্য সহায়তা: দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ইত্তেফাক সহ দেশের বিভিন্ন লিডিং পত্রিকা। ছবি:সংগ্রহ
Discussion about this post