চট্টগ্রাম, ৬ ডিসেম্বর, ২০২২:
দেশের মাটিকে রক্ষা করা দেশের নাগরিকের দায়িত্ব। সে দায়িত্ববোধের কারণে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। কোনো সার্টিফিকেটের জন্য যুদ্ধে যায়নি। অথচ সে সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, আজ তারা শতশত সার্টিফিকেট নিয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামে জীবনের পড়ন্ত বেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সুজিত নাগের সাথে একান্ত আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। তিনি স্বর্গীয় মনমোহন নাগ ও মাতা সুষমা নাগের ৬ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে কনিষ্ট সন্তান।
এ বীর মুক্তিযোদ্ধার দুই ছেলে পীযুষ নাগ ও মিথুন নাগ। বড় ছেলে মিথুন বেলুড় মঠে আছেন। ছোট ছেলে পীযুষ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আজ থেকে ৩৬ বছর আগে মারা যায় স্ত্রী। এর পর একা হয়ে পড়েন তিনি।
মা-মাটির স্মৃতি বিজড়িত গ্রাম ছেড়ে তিনি যাননি আর কোথাও। ছেলেরা শহরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। যাননি, যেতে পারেননি শেকড়ের টানে।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বয়স তখন ২৬। পলি টেকনিক্যাল থেকে ডিজাইনের উপর ডিগ্রি নিয়েছি সবেমাত্র। দেশ উত্তাল, পাকিস্তানী সৈন্যরা একের পর এক বর্বরতা শুরু করেছে। সিদ্ধান্ত নিই- যুদ্ধে যাব। কুমিল্লা হয়ে ভারতে চলে যায়। প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধে অংশ নিই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করেছি।
স্বাধীনতার পর তার উপর নির্যাতন হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর এরপর পেট্রোবাংলাতে কর্মরত ছিলাম। এরপর ১৯৭৪ সালে তখন আমেরিকান কোম্পানি মার্চেন্সে চাকরি করতাম। বোয়ালখালীতে তখন সার্কেল অফিসার ছিলেন এনামুল হক। তিনি জামায়াত বলেও মারধর করে জেল খাটিয়েছে। বহু নির্যাতনের পর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আমাকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে উদ্ধার করেছিলেন। স্বাধীন দেশে কখনো আমাকে আওয়ামী লীগ করি, কখনো বিএনপি করি, কখনো এটা করি ওটা করি বলে মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে বহুবার। স্বাধীনতার পরে তিনবার জেল খেটেছি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সুজিত নাগ বলেন, স্বাধীনতার পর এক বান টিনও পায়নি, পায়নি কোনো সরকারি সুবিধা। বর্তমানে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছি। এতেই আমার চলে যায়।
তিনি বলেন, খারাপ লাগে তখন, যখন দেখি ১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি, তারা আজ মুক্তিযোদ্ধা সেজে সরকারি ভাতা তুলছে। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলতেও ভয় লাগে, কেন না তারা সংখ্যায় বেশি। স্বাধীনতার পরে দেশে এসে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা সেজে গেছেন। স্বঘোষিত কমান্ডার হয়ে গেছেন অনেকে। সেই কমান্ডারের দায়িত্ব কারা দিয়েছিল তা আমার বোধগম্য হয় না।
যাদের নিজের মুক্তি নেই, লেখনীর মুক্তি নেই তারা কিভাবে দেশের মুক্তির কথা বলে। বিজয় মেলায় যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বক্তব্য দিতে দেখি তখন অসহায় বোধ করি নিজেকে।
সঠিক হলেও তা আজ বলা সম্ভব নয়। তাদের ক্ষমতা দাপট এত বেশি, যা বললে প্রাণ সংশয় রয়েছে বলেও জানান তিনি। দলীয় আশ্রয়ের রয়েছে তারা। স্বাধীনতার পরবর্তীতে দেখেছি মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারকে রক্ষা করতে, রাজাকারের মেয়ে বিয়ে করতে।
তিনি বলেন, ঘৃণা হয়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যখন দিনমজুরি করছে। সারোয়াতলীর জাফর, ভূপাল পারিয়াল, বিমল দে, পুলিন দাশ ধনা, অনন্ত বিশ্বাসসহ অনেকে অন্ধ হয়ে ধুকে ধুকে মরছে। তাদের বউ, ছেলে-মেয়েরা মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাচ্ছে। তাদের পক্ষে সম্ভব না মন্ত্রণালয়ে যাওয়া, হাজার টাকা দিয়ে সনদ নেয়া। এমন ঘটনাও ঘটেছে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী সনদ পেতে ঢাকায় গিয়ে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে।
যখন সরকার ভাতা দেয়নি তখন কি মুক্তিযোদ্ধা সনদ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, না। তখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কতছিল, আজ কত? প্রশ্ন রাখেন তিনি।
তিনি মনে করেন, শাস্তির বিধান রেখে মুক্তিযোদ্ধা দাবিদারদের যদি যাচাই বাছাই করা হয়, অনেকে পালিয়ে যাবে। ‘সরকার যাকে ইচ্ছা তাকে টাকা দেবে তাতে আমার কি। তবে খারাপ লাগে এসব চোরদের জন্য কি যুদ্ধে গিয়েছিলাম’- বলেন তিনি
একবার মরার জন্যই দেশ মাতৃকার টানে দেশের যুদ্ধে গিয়েছিলাম। বাঘের মতো বার বছর বাঁচায় অনেক আনন্দ। কুকুরের মতো বহুবছর বছর বেঁচে থেকে লাভ কি ? এমন প্রশ্নও রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুজিত নাগ।
তিনি বলেন, জীবনে অসততামূলক কোনো কাজ করিনি। সৎ ছিলাম বলেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে কারো কাছে হাত পাতিনি। কেন না জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তা পারিনি, আত্মমর্যাদার জন্য।
সারোয়াতলীতে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট জনদের নিয়ে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বোয়ালখালীতে প্রথম স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছিলেন সুজিত নাগ। তিনি বলেন, এ স্মৃতিসৌধে শহীদ ভবন করার স্বপ্নে নাম দিয়েছিলাম শহীদ ভবন। এর জন্য স্যার আশুতোষ কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রহিম প্রায় ৫০ শতক জায়গা দিয়েছিলেন। মনে বেদনা রয়ে গেছে, ভবনটি যা আজো করা সম্ভব হয়নি।
এখন পড়ন্ত বেলায় এসে গেছি। সরকার যে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে তা নিয়ে মরতে চাই এ মাটির বুকে।
Discussion about this post