চট্টগ্রাম, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩
চট্টগ্রামের যে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল জঙ্গল সলিমপুরকে বেদখলমুক্ত করার কাজ সেই জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বদলি হয়ে গেছেন। একই সাথে জঙ্গল সলিমপুরকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে দখলমুক্ত করতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎকালীন মুখ্যসচিব ও চট্টগ্রামের সন্তান ড. আহমদ কায় কাউস। তিনি এখনবিশ^ ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক।
দখলদার সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের কাছ থেকে জঙ্গল সলিমপুর উদ্ধারকারী কর্তাব্যক্তিরা না থাকায় সলিমপুরকে নিয়ে যে পরিকল্পনা ছিল সেটার অগ্রগতি থমকে পড়েছে।
এই জঙ্গল সলিমপুর আদৌ উদ্ধার করা যাবে কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ-শঙ্কা উৎসাহী চট্টগ্রামবাসী ও পরিবেশবাদীদের।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান জঙ্গল সলিমপুরকে সন্ত্রাসী ও দখলদারমুক্ত করতে সরকারি খাস খতিয়ানের ২ হাজার একর জায়গার উপর একটি বড় পরিকল্পনা গ্রহণ করে। স্পোর্টস কমপ্লেক্স, কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তর করা, আইকনিক মডেল মসজিদ, জাতীয় তথ্যকেন্দ্র, নভো-থিয়েটার ও ইকোপার্ক করার মহাপরিকল্পনা নেয় সরকার। সেই অনুযায়ী তথ্য মন্ত্রীসহ কয়েকজন সংসদ সদস্য, চট্রগ্রাম সিটি মেয়র ও সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তারা দফায়-দফায় পরিদর্শন করেন।
সর্বশেষ গত ১৫ জুলাই, শুক্রবার স্থানীয় সরকার চট্রগ্রাম বিভাগের উপ পরিচালক বদিউল আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নাজমুল আহসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) মাসুদ কামাল, সীতাকু- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)মোঃ শাহাদাত হোসেন, রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) মং মারমা ও সীতাকু- উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোঃ আশরাফুল আলম ও সলিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আজিজ জঙ্গল সলিমপুর ও আলীনগর এলাকা পরিদর্শনে যান। পরিদর্শন শেষে স্থান ত্যাগ করার সময় সরকারি কর্মকর্তাদের বহনকৃত পিছনের গাড়িতে ছিল স্থানীয় ইউপি সদস্য মোঃ আরিফ ছিল। এ সময় জঙ্গল সলিমপুর আলীনগর এলাকার দুর্র্ধষ ও শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং কুখ্যাত ডাকাত ইয়াসিনের নেতৃত্বে ইউপি সদস্য আরিফের উপর বর্বরোচিত ভাবে হামলা চালিয়ে গুরুতর আহত করে। পরে বিষয়টি জানতে পেরে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এগিলে আসলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। এরপর ইউপি সদস্য আরিফের ছোট ভাই আব্দুল আলিম বাদী হয়ে সীতাকু- মডেল থানায় ৬জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা পরবর্তী আসামিদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করেছিলেন। এরপর থেকে জঙ্গল সলিমপুর নিয়ে সরকারের প্রধানকর্তা প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং মন্ত্রী পরিষদ বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে একাধিক বার আলোচনা হয়েছে এবং সেই মোতাবেক সরকারের কর্তাব্যাক্তিরা সেখানে স্থায়ী বসবাসকারিদের জন্য ৬ থেকে ৮ হাজার প্লট নির্মাণ, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক থেকে জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় অফিস সময়ে একজন সহকারী কমিশনার ভুমি দায়িত্বে থাকছেন। একই ভাবে একজন এস.আই ও একজন এ.এস.আইসহ ২১জন পুলিশ ২৪ ঘন্টা দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দৌড়ঝাপ আগের মত নেই। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের একজন সহকারি কমিশনার ভুমি থাকলেও উনাকে গিয়ে পাওয়া যায়নি। পুলিশ রয়েছে,তবে পুলিশের এস.আইকে ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি। জঙ্গল সলিমপুরের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে পুলিশের এক এ.এস.আইকে কিছু বলার জন্য বললে উনি অপারগতা বলে মুখ ঘুরিয়ে নেন। জেলা প্রশাসক ও আইন-শৃঙ্গলা বাহিনীর তৎপরতা যখন চোখে পড়ার মত ছিল,তখন সন্ত্রাসী,চাঁদাবাজরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল। ফের এসকল সন্ত্রাসীসহ অপরাধকারিদের আনাগোনাও চোখে পড়ার মত ছিল। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের এই ঝিমিয়ে পড়াকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জঙ্গল সলিমপুরের একাধিক বাসিন্দারা। তারা বলেন,“আমরা দুই যুগেরও বেশি সময় এই জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় বসবাস করছি। আমাদের উচ্ছেদ করলে,আমরা কই যাবো।”
শাহ আলম নামে এক দোকানদার বলেন,“আগের মত সরকারি লোকজন তেমন আসে না,স্যার একটা আগে নিয়মিত আসলেও এখন সময় সময় আসে,আবার কোন কোন সময় একদম আসে না,পুরনো ডিসি স্যার চলে গেছে শুনছি,তবে নতুন ডিসি স্যার এখনো আসে নি। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের আগের মত আনা-গোনা দেখা যায় না।”
উপজেলার সলিমপুর ইউনিয়নের জঙ্গল সলিমপুর ১নং ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার ৮শত জনের মত। আর এই বিশাল ভোটারের এক-তৃতীয় অংশ হচ্ছে দেশের উত্তর বঙ্গসহ বিভিন্ন এলাকা আসা নানা অপরাধে অভিযুক্ত জনগোষ্ঠি। এই অপরাধীরা জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। সংঘবদ্ধ হয়ে খুন, ডাকাতি, মাদক ব্যবসা ও পাহাড় কাটা যাদের প্রধান কাজ। অভিযোগ রয়েছে, তাদের টাকার কাছে অনেক সময় জিম্মি হয়ে পড়েছে প্রশাসনের কিছু কর্তা ও কর্মচারী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জঙ্গল সলিমপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে সাবেক ইউপি সদস্য গোলাম গফুর ও গাজী সাদেক। তাদের নেতৃত্বে হুম, খুন ও ডাকাতিসহ একাধিক মামলার আসামি মশিউর ও রিপন। আর আলীনগর নিয়ন্ত্রণ করে বড় রাজা মোহাম্মদ ইয়াসিন ও ছোট রাজা মোহাম্মদ ফারুক। এভাবে একাধিক বাহিনী একাধিক নামে এই জঙ্গল সলিমপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রথমে তারা সরকারি খাস খতিয়ানের জায়গা দখল করে বিভিন্ন নামে। মুক্তিযোদ্ধা বসতিনগর, মায়ের আঁচল, আল মদিনা হাউজিং সোসাইটি, ছিন্নমূল সমাজ উন্নয়ন সংগঠন, চৌধুরী হাউজিং, নাহার ক্যাটেল ফার্মসহ নানা নামে জায়গা দখল নিয়ে তাদের রাজত্ব কায়েম করে। পরে তারা সরকারি লিজ নিয়ে সেখানে অবৈধ ও অপরাধী কার্যক্রমের বিস্তার করে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গার এসব সন্ত্রাসীরা খুন-খারাবি করে এখানে এসে আশ্রয় নেয়।
সরকারের নানা উদ্যোগের কথা শুনে এলাকার যেসব মানুষ খুশি হয়েছিল তারা এখন এসব কার্যক্রম থমকে পড়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
সাবেক জেলা প্রশাসক চলে যাওয়ায় তারাও মনে করছে সরকারের সব প্ল্যানও ভেস্তে গেছে।
এ ব্যাপারে সীতাকু- উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা মোঃ শাহাদাত হোসেন বলেন, জঙ্গল সলিমপুরের কাজ মাষ্টারপ্ল্যান অনুযায়ী চলছে। সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশন যৌথভাবে এই মাষ্টার প্ল্যানের কাজ করছে। প্ল্যান অনুযায়ী কাজ শুরু হবে।
সীতাকু- উপজেলার ১০নং সলিমপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড জঙ্গল সলিমপুর ও জঙ্গল সলিমপুরের অধীনে আলীনগর এলাকা হচ্ছে অপরাধীদের অভয়ারণ্য। যেখানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রাতের বেলা তো দূরে থাক, দিনের বেলায় আইন-শৃঙ্খলা কাজে যেতে আতংকের মধ্যে থাকতে হত। সেখানে বসবাসকারী বেশির ভাগ লোক দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে খুন, ডাকাতি, মাদকসহ নানা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে জঙ্গল সলিমপুর অপরাধের রাজত্ব গড়ে তুলে।
Discussion about this post