চট্টগ্রাম, ৯ জুন, ২০২৩:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠিত করার অন্যতম রাজনীতিক‘রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্ব’ ও বাংলাদেশের রাজনীতির রহস্যপুরুষ হিসাবে পরিচিত সিরাজুল আলম খান আর নেই। আজ বেলা আড়াইটার দিকে(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) ঢাকা মেডিকল কলেজ হাসপাতালে ৮২ বছর বয়সে তিনি মারা যান বলে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক জানান। তিনি বলেন, শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে হার্ট অ্যাটাক হয় সিরাজুল আলম খানের। তাতে তার অবস্থার অবনতি হয়। ডাক্তররা চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেননি।
এর আগে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন চির কুমার সিরাজুল আলম খান।
গত ৭ মে রাতে শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা নিয়ে পান্থপথে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি হন সিরাজুল আলম খান। এরপর চিকিৎসকদের পরামর্শে ২০ মে তাকে ঢামেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বৃহস্পতিবার (৮ জুন) রাত সোয়া ১১টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। ৮২ বছর বয়সী সিরাজুল আলম খান অনেক দিন ধরে উচ্চ রক্তচাপসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।
দিন দিন তার শারীরিক অবস্থা আরও অবনতি হচ্ছে জানিয়ে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেছিলেন, মাঝেমধ্যে তার শরীরে জ্বর বেড়ে যায়। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।
জানা গেছে, তার মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে নিয়ে আলমারকাজুলে গোসল করিয়ে, শমরিতা হাসপাতালের হিমঘরে আজ রাখা হবে।
আগামীকাল সকাল ৮টায় শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বায়তুল মোকাররমে দক্ষিণ গেটে রাখা হবে। অতঃপর সকাল ১০টায় জানাজা।
সিরাজুল আলম খানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাজনীতিবিদগণ। বাসদ, জাসদ, বিএনপি সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেছেন, ষাটের দশকের প্রথমার্ধে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খানসহ অন্যরা স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেছিলেন। সিরাজুল আলম খানের মৃত্যু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি কালপর্বের অবসান এবং জাতির জন্য অপুরণীয় ক্ষতি।
দাদা ভাই নামে খ্যাত সিরাজুল আলমের মৃত্যুতে শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (বাংলাদেশ ন্যাপ) চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া। বাংলাদেশের ইতিহাসে সিরাজুল আলম খানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে উল্লেখ করে গণফোরাম সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টু ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে সিরাজুল আলম খানের মতো দেশপ্রেমিক আজীবন বিপ্লবীকে হারানো দেশ ও জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
সিরাজুল আলম খানের জন্ম নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার আলীপুর গ্রামে, ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি। তার বাবা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন, গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৫৬ সালে সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর ‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণ করায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহ সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩ সালে সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে বাংলাদেশীদের স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ’৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে নিউক্লিয়াস গড়ে উঠে তিনিই ছিলেন তার মূল উদ্যোক্তা। ১৯৬০ এর দশকের আগে থেকে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন।মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক সিরাজুল আলম খানের গঠন করা ‘নিউক্লিয়াস’ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামেও পরিচিত। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গঠন এবং ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যুত্থান’-এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।
তবে মৃত্যুর পর রাজনীতির এ রহস্য পুরুষকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানানো হোক- এমনটা চান না তার পরিবার। শুক্রবার সিরাজুল আলম খানের ছোটভাই ফেরদৌস আলম খান গণমাধ্যমকে এমনটাই জানান। তিনি বলেন, দাদা ভাই সিরাজুল আলম খান সবসময় প্রচারণার বাহিরে থেকেছেন।
তিনি মৃত্যুর আগে তার কিছু আশার কথা বলে গিয়েছেন। তিনি মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চান না। সিরাজুল আলম খান বলে গেছেন তাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়। এমনকি দাফনের সময় তাকে কাফনের বদলে মায়ের কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে দাফন করার ইচ্ছার কথা জানিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, মায়ের শাড়িটাই আমার কাছে পতাকা। আমি এই পতাকা নিয়েই আমি চলে যেতে চাই।
সিরাজুল আলম খানের ভাতিজি ব্যারিস্টার ফারাহ আলম খান বলেন, চাচা বলে গেছেন- মৃত্যুর পরে আমাকে কোথাও রাখার দরকার নেই। আমাকে যেনো ডিসপ্লে করা না হয়।
আমার জন্য হাজার হাজার ফুল আসার দরকার নেই। আমি দেশটা স্বাধীন করতে চেয়েছিলাম। আমি স্বাধীন করতে পেরেছি। সেটাই আমার বড় অর্জন। আমি কারো কাছে কিছু চাই না।
আগামীকাল সকাল ১০টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সিরাজুল আলম খানের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মায়ের কবরের পাশেই শায়িত করা হবে।