# সিরাজুল আলম খান
আমার সঙ্গে শামসুদ্দিন পেয়ারার যেটুকু কথোপকথন, তা থেকে বড় আকারের (২০০ পৃষ্টার মতো) একটি বই হবে, সেটা আমার ধারণায় ছিলো না।
স্কুল জীবনের কথা বাদ দিলেও কলেজ জীবন থেকে রাজনীতিতে আমার চলাফেরা শুরু। এ চলাফেরার প্রথমদিকে আমি কল্পনাও করিনি আমাকে বড় ধরণের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত হতে হবে। শৈশব-কৈশোরে আমার বাবার কাছ থেকে যেসব কথাবার্তা শুনেছি সেটাই রাজনীতিতে আমার জড়িত হওয়ার প্রধান কারণ। সেসব কথা প্রাথমিকভাবে আমার রাজনৈতিক জীবন গড়ে উঠতে কিছুটা হলেও সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। ছোটবেলায় বাবার কাছে শেখা ‘ডিসিপ্লিন’ আমার পুরো জীবনকে প্রভাবিত করেছে প্রবলভাবে।
স্কুল জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন উপলক্ষে আমাকে ও আমার বড় ভাইকে ‘প্রভাতফেরী’র দুই সারির সম্মুখভাগে থাকতে হতো। কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের পছন্দ অনুযায়ী এটা করা হতো। কী কারণে খুলনা জেলা স্কুল ও ঢাকা কলেজের ছাত্রাবস্থায় একুশে ফেব্রুয়ারির ‘প্রভাতফেরী’র গান গাওয়ার জন্য ‘সিনিয়র’রা আমাকে দায়িত্ব দিতেন, সেটা আমি অনেক পরে বুঝেছি।
১৯৫৮ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখনই আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ জারি হয়। ১৯৫৯ সালে ‘সাবসিডিয়ারি’ পরীক্ষার পর লম্বা ছুটিতে আমি ‘দিল্লি’ বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার বয়স তখন আঠারো। ১৪ আগস্ট দিল্লিতে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে নিজেকে খুবই ‘অসহায়’ মনে হয়েছিলো। পূর্ব পাকিস্তান নামের একটি প্রদেশের নাগরিক হওয়াটা যে কতো অসম্মানের বা অপমানজনক, সেদিন তা বুঝতে পেরেছিলাম।
চিন্তার জগতে আমাকে ‘স্বাধীনতা’ বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করেছিলো তৎকালীন আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রাম, কিউবার বিপ্লবী আন্দোলন, ভিয়েতনামে আমেরিকার বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের লড়াই এবং ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর নানা দেশে নিপিড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে ‘পূর্ব বাংলা’র (পূর্ব পাকিস্তান) ‘স্বাধীনতা’র বিষয়টি এক সময় আমার মাথায় ঢুকে পড়ে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ‘ভারতীয় বাঙালি’ ও ‘পাকিস্তানি বাঙালি’ অথবা ‘হিন্দু বাঙালি’ ও ‘মুসলমান বাঙালি’-বাঙালি জাতিসত্তার এই খণ্ডিত পরিচয়কেই অনেকে তার চূড়ান্ত বা শেষ পরিচয় বলে ধরে নিয়েছিলো। উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎ এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের গবেষকদের মনেও এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায়। বাঙালি যে আবার কোনোদিন নিজ পরিচয়ে পৃথিবীর বুকে অবস্থান করে নিতে পারে এটি ছিলো তাদের কাছে কল্পনাতীত ব্যাপার। যদিও রবীন্দ্রনাথ, লালনশাহ্, শরৎ চন্দ্র, নজরুলসহ অনেক মনিষী-লেখক-কবি তাঁদের দর্শন ও সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে বাঙালির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছিলেন। ১৯৩৪ সালে বিহার প্রদেশে অনুষ্ঠিত ‘প্রবাসী বঙ্গীয় সাহিত্য’ সম্মেলন-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের অংশ হলেও কার্যত বাংলা ও বাঙালি সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন দেশ এবং ভিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী’। এর পরেও বহুকাল বাঙালিকে তার জাতিসত্তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তার সূচনা হয়েছে।
১৯৬২ সাল। আমার বয়স তখন একুশ বছর। ঘটনাক্রমে একদিন আমি, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ একসঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় ‘স্বাধীনতা’র প্রসঙ্গটি আমাদের আলোচনায় আসে। এভাবে অভিজ্ঞতা ছাড়া শুধুমাত্র তারুণ্যের স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষাকে সম্বল করে শুরু হয় ‘স্বাধীনতা’র জন্য আমাদের ‘পথচলা’। আমরা দশ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলাকে ‘স্বাধীন’ করবো এ সংকল্প নিয়ে কাজ শুরু করি। কিন্তু নয় বছরের মাথায়ই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ‘স্বাধীনতা’ অর্জন করে। আমাদের এ নয় বছরের পথপরিক্রমাকে আজকের হিসেবে মনে হবে কয়েক যুগ।
‘নিউক্লিয়াস’ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ) নামক একটি সংগঠনের মাধ্যমে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। সে সময় আমার, রাজ্জাকের ও আরেফের বয়স ছিলো যথাক্রমে ২১, ২০, ১৯। ‘নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক উইং হিসেবে আমরা ‘বিএলএফ’ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) গঠন করি। পরবর্তীতে শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদ ‘বিএলএফ’-এ যুক্ত হন। কাজী আরেফ আহমেদ ছিলেন‘ ‘বিএলএফ’-এর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে ‘নিউক্লিয়াস’-এর এই রাজনৈতিক উইং ‘বিএলএফ’ এবং সামরিক উইং ‘জয়বাংলা বাহিনী’। ‘বিএলএফ’-এর সদস্য সংখ্যা ছিলো তখন ৭ হাজারের মতো।
‘নিউক্লিয়াস’, ‘বিএলএফ’ ও ‘জয়বাংলা বাহিনী’ গঠনের মাধ্যমে আমরা ছাত্র-যুবকদের মধ্যে স্বাধীনতার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রামের মন-মানসিকতা গড়ে তুললাম। আমাদের সেই প্রয়াস-প্রস্তুতি ও চলমান ঘটনাবলির পাশ কাটিয়ে আমাদের দেশের ‘একচোখা বুদ্ধিজীবীরা’ ‘৭১-এর ২৫ মার্চের আগের দিনও বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা’র স্বপ্ন দেখতে পেলেন না। এটা আমাদের জন্য এক লজ্জাকর কাহিনী।
শুধু বুদ্ধিজীবীরাই নন, আওয়ামী লীগসহ এ দেশের ছোট-বড় কোনো রাজনৈতিক দলই মার্চ মাসের আগে ‘স্বাধীনতা’র বিষয়টিকে সমর্থন করেনি; এমনকি তাদের রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যেও ‘স্বাধীনতা’বিষয়টি ছিলো না। তবে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবস্থানটি ছিলো একেবারেই ভিন্ন। ১৯৬৯ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকে মুক্তি লাভের পরই বঙ্গবন্ধুকে ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’ সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তখন থেকে তিনি (বঙ্গবন্ধু) ‘স্বাধীনতা’র প্রশ্নে শুধু আপোষহীনই ছিলেন না, ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর কর্মকান্ড সমর্থন করতেন এবং আমাদের যে কোনো পদক্ষেপে উৎসাহ যোগাতেন।
এখানে স্পষ্টভাবেই বলা প্রয়োজন, আওয়ামী লীগ দলগতভাবে ‘স্বাধীনতা’র বিষয়টিকে সমর্থন করেনি। এমনকি বঙ্গবন্ধুও ১৯৬৯ সালের আগে ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’র কর্ম-তৎপরতা সম্পর্কে জানতেন না। প্রথমদিকে আওয়ামী লীগ স্লোগান হিসেবে ‘জয়বাংলা’র বিরোধিতা করলেও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও অবস্থান এবং ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর প্রচন্ড চাপ ও সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানকে তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই ‘জয়বাংলা’ স্লোগানই ‘স্বাধীনতা’ অর্জনের লক্ষ্যে জনগণের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণের প্রধান সয়াহক হয়েছিলো। জেলা ও মহকুমা (বর্তমানে জেলা) পর্যায়ে আওয়ামী লীগ-এর দু’-একজন ‘নিউক্লিয়াস’কে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন। অন্যান্য দলেরও অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ‘নিউক্লিয়াস’ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং ‘স্বাধীনতা’র বিষয়টি সমর্থন করতেন।
কাজী আরেফ আহমেদ আজ বেঁচে নেই। আবদুর রাজ্জাকও চলে গেছেন। আমরা তিনজন সব বিষয়ে একমত পোষণ করতাম এবং একই পথে হাঁটতাম। ১৯৬২ থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো বিষয়ে এক মুহূর্তের জন্যও আমাদের মধ্যে মত-পাথর্ক্য হয়নি।
এই বইটি মুদ্রণের ঠিক আগে শামসুদ্দিন পেয়ারা একবার হলেও পাণ্ডুলিপিটিতে চোখ বুলাতে বললো। সে কারণে বইটিতে কী আছে আমি জানতে পারলাম। ৬ জানুয়ারি, ২০১৯-এ আমার বয়স আটাত্তর হয়েছে। শামসুদ্দিন পেয়ারা তার লেখায় আমার জীবনের যে পর্বটি তুলে ধরেছেন, তা আমার জীবনের কেবল একাংশ। তবে আমার রাজনৈতিক জীবনের প্রথমভাগের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ তার লেখায় তুলে ধরা হয়েছে। কখনও যদি আমার জীবন নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হয় (আত্মজীবনীমূলক) লেখা হয়, তবে তা হবে একটি অতি প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সাহিত্য।
পাঁচ বছর জেলে থাকার পর ১৯৮১ সালে আমি মুক্তি লাভ করি। জেল থেকে বের হওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম গোটা দেশটাই এক জেলখানায় পরিণত হয়েছে। অন্যরা জেল থেকে মুক্ত হয়ে ভিন্ন জীবন বেছে নেয়; সংসার জীবন শুরু করে; জীবিকা উপার্জনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে; দু’-চারজন অবশ্য রাজনীতিকেই তাদের ‘মূলজীবন’ করে তোলে।
এরশাদ সাহেবের সামরিক শাসন বহাল থাকার সময়ে আমি রাজনীতিতে আর শুধুমাত্র ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ হয়ে থাকলাম না। পাঁচ বছরের জেলজীবন আমার চিন্তা জগতে মৌলিক পরিবর্তন আসে, তা আমার রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনে সহায়ক হয়। সে সময়ে জেলখানায় আমি প্রতিদিন গড়ে ১৫/১৬ ঘণ্টা পড়াশুনা করতাম। একজন ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ কীভাবে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ ‘রাজনৈতিক সত্তা’য় পরিণত হয়, আমি তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
১৯৮৫ সালে ড. জিল্লুর রহমান খান-এর সঙ্গে আকস্মিক যোগাযোগ আমাকে নতুন রাজনীতির মানুষ হিসেবে আর্বিভূত হতে সাহায্য করে। সেই সময় থেকে তিনি ও আমি একযোগে কাজ করতে থাকি। এর ফলে গত ৩০/৩৫ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতির জগতে নতুন চিন্তার ক্ষেত্র তৈরী হয়। সে বিষয়গুলো শামসুদ্দিন পেয়ারার লেখায় অন্তর্ভুক্ত না হলেও তাঁর এ লেখায় আমার সে বৌদ্ধিক রাজনৈতিক জীবনের কিছু আভাস পাওয়া যাবে।
# লেখাটি সিরাজুল আলম খানের ফেসবুক থেকে নেওয়া। ২০১৯ এর জানুয়ারিতে লেখা।
সিরাজুল আলম খান:সিরাজুল আলম খান বিখ্যাত রাজনীতিবিদ। জন্ম নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার আলীপুর গ্রামে, ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি। তার বাবা খোরশেদ আলম খান ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন, গৃহিণী। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৫৬ সালে সালে খুলনা জেলা স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর ‘কনভোকেশন মুভমেন্টে’ অংশগ্রহণ করায় তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৬১ সালে ছাত্রলীগের সহ সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৬৩ সালে সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে বাংলাদেশীদের স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ’৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে যে নিউক্লিয়াস গড়ে উঠে তিনিই ছিলেন তার মূল উদ্যোক্তা। ১৯৬০ এর দশকের আগে থেকে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। সিরাজুল আলম খানের গঠন করা ‘নিউক্লিয়াস’ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামেও পরিচিত। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ গঠন এবং ‘সিপাহী জনতার গণ-অভ্যুত্থান’-এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।
Discussion about this post