চট্টগ্রাম, ২৫ মে, ২০২৫:
পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত ও পলাশ মৃত্তিকা পুষ্ট এই বাংলাদেশ। ষড় ঋতুর লীলা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ এবং ধান-গান-নিসর্গ সৌন্দর্য এদেশ ও এদেশের মানুষের প্রাণের সম্পদ- একসূত্রে গাঁথা। দুঃখ-বেদনা-আনন্দ ভালোবাসার ছায়ায় ও ছোঁয়ায় পুষ্ট প্রতিটি মানুষের হৃদয়সত্তা গান তার উপলব্ধির প্রকাশ-সুষমা। হাজার বছর আগের চর্যাপদ থেকে শুরু করে শাস্ত্র সঙ্গীত ও বৈষ্ণব-সাহিত্য পদাবলী কীর্তনের মধ্য দিয়ে বাঙলার মানুষের আবহমানকালের মানস কমলের পরিচয় বিধৃত। পরবর্তীকালে রামপ্রসাদ-রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদ-নজরুল ইসলামে এসে এই সাঙ্গীতিক ধারাটি যেন একটি অতলস্পর্শী সীমাহীন প্রশান্ত সমুদ্রের রূপ নিয়েছে। কবিতার ধারাটির পাশাপাশি সঙ্গীতের স্বতঃস্ফূর্ত এই ধারাটি থেকেও সুদীর্ঘকাল গৌড়জন ‘আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।’
কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গানগুলির মধ্যে হামদ ও নাতে- রসূল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দ্রষ্টার ধ্যানমগ্ন হৃদয়ের জীবন্ত প্রতিচ্ছবিই এসব পান। চলতি শতকের গোড়ার দিকে ঘুমন্ত বাঙালী মুসলিম জাতিকে জাগিয়ে তোলার জন্য নজরুল ইসলামের এসব গান রাজনৈতিক বক্তৃতামালার চেয়েও সহস্রগুণ শক্তিশালী ছিল। ইসলামের ইতিহাস ও মিথ ঐতিহ্য সম্বলিত গানগুলি মুসলিম সম্প্রদায় বিশেষ করে সমকালীন তরুণ সমাজের কাছে ছিল সঞ্জীবনী সুধার মত। তাঁর অসাধারণ জনপ্রিয়তার পেছনে শুধু ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও কবির নামের পেছনে, অনিবার্যভাবে ব্যবহৃত ঐ বিশেষণের শিরোপাই অন্যতম ছিলো না। জাগরণমূলক ও ঐতিহ্যপুষ্ট অজস্র গানই তাঁকে বাঙলার মুসলমানদের ঘরে ঘরে পরিচিত করে তুলেছিল। শিক্ষিত সমাজ তার দ্রোহমূলক কবিতা, গান কিংবা প্রবন্ধ, সম্পাদকীয়, অভিভাষণ ইত্যাদি নিয়ে মেতে উঠলেও সাধারণ মানুষ তাঁকে তার গানের মাধ্যমেই বেশি করে চেনে ও জানে। তাই মুসলিম সমাজের সেই সুদীর্ঘকালের লালিত সংস্কারের অচলায়তন ভাঙতে যিনি সর্বাগ্রে ইসলামী গানের মাধ্যমে আগ্রহ ও আকুলতা
প্রকাশ করেছিলেন তাঁকে আজকের দিনে কী ধর্মীয়, কী রাজনৈতিক, কী সামাজিক, কী-ঐতিহাসিক সকল দিক থেকেই স্মরণ না করে উপায় নেই। সেদিনের সেই গোঁড়া অন্তঃসারশূন্য ও রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে যেখানে গান-বাজনা রীতিমত হারাম ছিল, কাঠমোল্লাদের ফতোয়ার প্রভাবে ও অত্যাচারে জনজীবন ছিলো অতিষ্ঠ, সেই দুঃসময়ে তিনি যে দুঃসাহসীকের ভূমিকা পালন করেছিলেন ইতিহাস আজ তাঁকে সম্ভবত: ভুলতে বসেছে।
এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী, এককালের সঙ্গীত জগতের কিংবদন্তীর নায়ক আব্বাসউদ্দীন আহমদই সর্বপ্রথম ইসলামী গান, হামদ, নাতে-রসূল, ছাত্রদলের গান, মুসলমানদের নানা ধর্মীয় উৎসব পার্বণের গান প্রচারের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এজন্য তাঁকেও কম বেগ পেতে হয়নি। তাঁর নিজের কথাতেই সেদিনের ইসলামী গান প্রচারের আগে-পরের প্রেক্ষিতের পরিচয় শোনা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন:
‘একদিন কাজীদাকে বললাম, ‘কাজিদা, একটা কথা মনে হয়। এই যে পিয়ারু কাওয়াল কাবু কাওয়াল এরা উর্দু কাওয়ালী গায়, এদের গানও শুনি অসম্ভব বিক্রি হয়, এই ধরনের বাংলায় ইসলামী গান দিলে হয় না? তারপর আপনি তো জানেন, কিভাবে কাফের কুফর ইত্যাদি বলে বাংলায় মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাংক্তেয় করে রাখার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ। আপনি যদি ইসলামী গান লেখেন তাহলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।’
কথাটা তাঁর মনে লাগল। তিনি বললেন, “আব্বাস তুমি ভগবতী বাবুকে বলে তাঁর মত নাও; আমি ঠিক বলতে পারব না।” আমি ভগবতী অর্থাৎ গ্রামোফোন কোম্পানীর রিহার্সেল-ইন-চার্জকে বললাম। তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, ‘না-না-না ওসব গান চলবে না। ও হতে পারে না।
প্রায় ছয়মাস পরে বৃদ্ধ আশ্চর্যময়ী ও ভগবতী বাবুর আলাপের এক বিশেষ আনন্দঘন মুহূর্তের সুযোগে শিল্পী আব্বাসউদ্দীন পূর্বের প্রসঙ্গটি ভগবতী বাবুকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি অগত্যা সম্মতি দেন। পরের ঘটনা, শিল্পী লিখেছেন:
শুনলাম পাশের ঘরে ঘরে কাজিদা আছেন। আমি কাজিদাকে বললাম যে ভগবতী বাবু রাজী হয়েছেন। তখন সেখানে ইন্দুবালা কাজিদার কাছে গান শিখছিলেন। কাজিদা বলে উঠলেন, ‘ইন্দু তুমি বাড়ী যাও আব্বাসের সাথে কথা আছে।” ইন্দুবালা চলে গেলেন। এক ঠোঙ্গা পান আর চা আনতে বললাম দশরথকে। তারপর দরজা বন্ধ করে আধঘন্টার ভিতরই লিখে ফেললেন, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ।” তখুনি সুর সংযোগ করে শিখিয়ে দিলেন। পরের দিন ঠিক এই সময় আসতে বললেন। পরের দিন লিখলেন, “ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর।” গান দুখানা লেখার ঠিক চারদিন পরেই রেকর্ড করা হল। কাজিদার আর ধৈর্য মানছিল না। তাঁর চোখে মুখে তী আনন্দই যে খেলে যাচ্ছিল। এই হল আমার প্রথম ইসলামী রেকর্ড। ২
ইসলামী গান প্রচার ও রেকর্ডিং এর প্রতিকূল অবস্থার কথা এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি থেকে জানা গেল সত্য কিন্তু যাদের জন্য, যে সমাজের মানুষের জন্য গীতিকার সুরকার ও শিল্পীর এই বিরাট আত্মত্যাগ সেই সমাজে এর প্রতিক্রিয়ার চিত্রটি শিল্পী নিজেই উল্লেখ করেছেন এভাবে:
“এর পর কাজিদা লিখে চললেন ইসলামী গান। আল্লা-রসূলের গান গেয়ে বাংলার মুসলমানের ঘরে ঘরে জাগল এক নব উন্মাদনা যারা গান শুনলে কানে আঙুল দিত তাদের কানে গেল, “আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি,”; “নাম মোহাম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল।” কান থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে তন্ময় হয়ে শুনল এ গান। আরো শুনল, “আল্লাহ আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়।” মোহররমে শুনল মর্সিয়া, শুনল “ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়।” ঈদে নতুন করে শুনল, “এল আবার ঈদ ফিরে এলো আবার ঈদ, চল ঈদগাহে।” ঘরে ঘরে এল গ্রামোফোন রেকর্ড, গ্রামে গ্রামে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আল্লা-রসূলের নাম। কাজিদাকে বললাম, কাজিদা, মুসলমান তো একটু মিউজিক-মাইণ্ডেড হয়েছে। এবার তরুণ ছাত্রদের জাগাবার জন্য লিখুন। তিনি লিখে চললেন, “দিকে দিকে পুন: জ্বলিয়া উঠিছে, শহীদী ঈদগাহে দেখ আজ জমায়েত ভারী, আজ কোথায় তখতে তাউস, কোথায় সে বাদশাহী।”
ইসলামী গান লিখিয়ে নেওয়া ও তার প্রচারের ব্যাপারে এই জনদরদী শিল্পীর অবদান আজো যথাযথ মূল্যায়িত হয়নি। তাঁর প্রচেষ্টায় গ্রামোফোন কোম্পানী রাতারাতি ফুলে ফেঁপে উঠেছে সত্য কিন্তু মুসলিম বাঙলায় ইসলামী গানের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে অধপতিত মুসলিমমানসে একটা ব্যাপক পরিবর্তনও যে এসেছিলো তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ গানের চাহিদার জন্য এ সময়ে অনেক হিন্দু শিল্পীও মুসলমান সেজে ইসলামী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। এঁদের মধ্যে ধীরেন দাস (গনি মিঞা), চিত্তরায়, (দেলোয়ার হোসেন, আশ্চর্যময়ী [সকিনা বেগম), হরিমতি (আমিনা বেগম), গিরীশ চক্রবর্তী (সোনা মিঞা অন্যতম ৪
নানা নামের লেবেল আঁটা গ্রামেফোন কোম্পানী থেকে ইসলামী গানের রেকর্ড বের হয়ে বাঙালি মুসলমানদের ঘরে ঘরে প্রচারিত হলেও কলকাতা রেডিও থেকে এ সব গান। প্রচারে তখনো যথেষ্ট বাধা ছিলো। সেখানেও আব্বাসউদ্দীন আহমদই সকল বাধা-বিপত্তি দূর করে কলকাতা রেডিও থেকে ইসলামী গান প্রচারের ব্যবস্থা করে বাঙালী মুসলমান সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করেছেন। ইসলাম ধর্মের কথা, মহানবীর আবির্ভাব-তিরোভাব, কারবালার যুদ্ধ, ইমাম হাসান-হোসেনের শোকাবহ ঘটনার বর্ণনা, শবেবরাত, শবেকদর, মুহররম, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ইত্যাদির জন্য বেতার প্রোগ্রামের সবচেয়ে বড়ো বাধা ছিল গোঁড়া মুসলিম সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা সমকালীন শিক্ষার অভাব মূলতঃ এ জন্য দায়ী। তৎকালীন কলকাতা রেডিও স্টেশন। ডিরেক্টর নৃপেন মজুমদার আব্বাসউদ্দীন আহমদের কথা বলেছিলেন, “না আব্বাস এ ধরনের প্রোগ্রাম এই প্রথম; মুসলমানরা যা গোঁড়া, আমার রেডিও অফিস উড়িয়ে দিবে।
আচ্ছা, তুমি যদি মাওলানা আকরম খাঁর কাছ থেকে ‘আপত্তি নেই’ বলে এই স্ক্রীন্টের ওপর তাঁর সই নিয়ে আসতে পার আমি ব্রডকাস্ট করব।”
মাওলানা আকরম খাঁ অবশ্য সেদিন আব্বাসউদ্দীন আহমদের হাতের স্ক্রীন্টে সানন্দে লিখে দিয়েছিলেন যে, “এই ধরনের জীবন্তিকা যতই প্রচারিত হয় ততই মঙ্গল।” মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রচারে এরপর থেকে বেতারে আর কোনো বাধাই রইলো না। পরে রমজান মাসে রেডিওতে আজান দেওয়ার ব্যবস্থাও গৃহীত হয়েছিল।
কবি শুধু এসব গান রচনা করেই দায়িত্ব শেষ করেননি সুরারোপ করেছেন, পরে নিজ তত্ত্বাবধানে তা রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থাও করেছেন। আব্বাসউদ্দিন জানিয়েছেন যে প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ ইসলামী গানের সুর কবির নিজস্ব। দুচারটি গানে সুর-সংযোজনার দায়িত্ব তিনি কমল দাশগুপ্ত ও চিত্তরায়কে দিয়েছিলেন মাত্র।
গান সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা ও বিশ্বাসের কথা তাঁর অন্তরঙ্গ ও রাজলাঞ্ছিত বন্ধু মুজফফর আহমদের কথাতেই জানা যায়। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন:
“নজরুল আসলে শুরু থেকেই সঙ্গীতে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। আমার মতো তার অরসিক বন্ধুরা তা বুঝতে পারত না। আমরা না বুঝে তাকে অনেক সময় আঘাত দিতাম। আমার মনে আছে, একদিন শ্রীভূপতি মজুমদার বলেছিলেন, “নজরুল, কী তুমি এত ভালো গান গাও যে গান পেলেই মেতে ওঠ।” সেদিন নজরুল খুব আহত হয়েছিল। সে বলেছিল, “ভূপতি দা আমার কবিতার যত খুশি সমালোচনা করুন, কিন্তু আমার গান সম্বন্ধে কিছু বলবেন না।” “পরে বুঝলাম নিজের ওপরে তার অনেক প্রত্যয় ছিল বলেই সে শ্রীমজুমদারকে ওই রকম বলতে পেরেছিল। গান সম্পর্কে কবির আরো উক্তি অন্যত্র ছড়িয়ে আছে- যার মর্মকথা মূলত: একই। এ নিরিখে গানের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ও দুর্বলতা এবং বিশ্বাস ছিলো অসাধারণ।
ইসলামী গানগুলি ছিলো তাঁর কলিজার টুকরো। কী বাণীর সারল্যে ও বৈভবে, কী সুরের মোহন যাদু ও অতলস্পর্শী আবেদনে বাঙলা সঙ্গীতে এ সম্পদ তুলনা-বিরল। সর্ব সংস্কারমুক্ত উদারহৃদয়-সুরজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই নজরুল ইসলামের এসব গানের সুরের বৈশিষ্ট্য। ও স্বাতন্ত্র্য স্বীকার করবেন বলে মনে হয়। কেননা, কখনো কখনো বাণীর অপূর্ণতাকে সুরের ছোয়ায় এবং সুরের অপূর্ণতাকে শব্দ সম্ভারের কারুকার্যে, বৈচিত্র্যে ও ঐশ্বর্যে তিনি গরীয়ান করে তুলেছেন। তাই হামদ ও নাতে- নাতে রসুল জাতীয় গানগুলিতে তিনি একক সম্রাটের মর্যাদায় সমাসীন। তাঁকে অতিক্রম করতে করতে পারেন বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে আজ পর্যন্ত তেমন কোনো প্রতিভার আবির্ভাব ঘটেনি এবং এ বিষয়ে তাঁকে অতিক্রম করাও খুব সহজ কথা নয়। তাছাড়া গান সম্পর্কে গীতিকার ও সুরকার নজরুল ইসলামের নিজস্ব ধারণা ও বিশ্বাসের কথা ইতোপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।
‘নাতে-রসূল’ পর্যায়ে কবির যে সব গানের সন্ধান পাওয়া গেছে তা মোটামুটি শ’খানেকের উপরে হবে। এসব গান জুিলফিকার’ ১ম খণ্ড ও ‘বনগীতি’র সংযোজন অংশে যা নজরুল
রচনাবলীর তৃতীয় খণ্ডে সঙ্কলিত হয়েছে।
#লেখাটি অসমাপ্ত
Discussion about this post