চট্টগ্রাম, ২০ জুন, ২০২৩:
ডিম সংগ্রহের পর দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদা নদীতে এখন কার্প জাতীয় মা মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) ডিম ফোটাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন পোনা সংগ্রহকারী ও বিক্রেতারা। গত শনিবার ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় মা মাছ। এদিন ২০২০ সালের পর এবার সবচেয়ে বেশি ডিম ছেড়েছে। রোববার রাত থেকে গতকাল সোমবার সকাল পর্যন্ত ডিম ছাড়া অব্যাহত ছিল।
ডিম সংগ্রহের পর হালদা নদীর দুই তীরে হাটহাজারী ও রাউজানের ডিম সংগ্রহকারীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। ২০২০ সালের পর এবার সবচেয়ে বেশি ডিম সংগ্রহ হওয়ায় মহাখুশি তারা। গত দুই বছরের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ ডিম ছেড়েছে (১৮-২০ হাজার কেজি) মা মাছ। এখন তারা সরকারি-বেসরকারি ছোট-বড় মোট ১৬টি হ্যাচারি ও ৭৮টি মাটির কুয়াসহ মোট ২শ ৬৭টি কুয়ায় ডিম থেকে রেণু ফোটাতে ব্যস্ত। প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকূলে থাকলে ৪-৫ দিন পর হালদা পাড়ে শুরু হবে উৎপাদিত রেণুর বিক্রির উৎসব। এজন্য ব্যস্ত সমস্ত তারা।
ডিম সংগ্রহকারীরা জানান, ডিম ফোটানোর প্রক্রিয়া চলছে, দম ফেলার সময় নেই। গত রবিবার রাতভর ডিম সংগ্রহ করে সকালে ডিম সংগ্রহকারীরা তা হ্যাচারিতে নিয়ে গেছেন। সেখানে কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক উপায় ১৮ ঘণ্টা পর ডিম থেকে রেণু পরিণত করতে তিনদিন ধরে রেণুগুলোকে নার্সিং করবেন। এরপর পোনায় পরিণত হবে সেগুলো। সংগ্রহের ৯৬ ঘণ্টা পর ডিম বিক্রয়যোগ্য পোনায় পরিণত হবে বলে আশা তাদের।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে হালদার পাড়ে ডিম সংগ্রহকারীরা জানান, সংগৃহীত নিষিক্ত ডিম তারা প্রথমে সনাতন পদ্ধতিতে মশারির নেট দিয়ে তৈরি বিশেষ জাল পেতে নৌকায় তোলেন। নৌকায় তক্তা ও মাটি দিয়ে কৃত্রিম পুকুরের মতো তৈরি করে রাখা হয়। এই গর্তেই সুতির কাপড় দিয়ে তাতে ডিম রাখা হয়। এরপর নদীর তীরে মাটির তৈরি কুয়ায় ছেড়ে দেন ডিম। ডিমকে কুয়ার মধ্যে পরিস্ফুটনের জন্য ৭-৮ মিনিট অন্তর অন্তর নড়াছড়া করতে হয়, যাতে ডিম ফোটানোর পর রেণুগুলো জালের নিচে পানির মধ্যে চলে যায়। যখন দেখা যায়, রেণুগুলো জালের ওপর নেই, তখন জাল পরিষ্কার করতে হয়। তারপর সদ্য রেণুগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করা জালে নিয়ে আরেকটি কুয়ার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়। নতুন কুয়ায় ছেড়ে দেয়ার ১৫-২০ মিনিট পর রেণুগুলোর চোখ ফোটে। ৪-৫ দিন পর রেণুগুলো পরিপূর্ণ হয়।
সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, ৩ শতাধিক পোনা সংগ্রহকারী রেণু ফোটানোর কার্যক্রম শুরু করেছেন। এবার ৪ কোটি টাকার বেশি রেণু উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
সরেজমিন তথ্যে জানা যায়, মদুনাঘাট হ্যাচারিতে ৩৬টি কুয়ায় ১৬৯ বালতি, শাহমাদারি হ্যাচারিতে ৪২ কুয়ায় ১৯০ বালতি ও মাছুয়াঘোনায় হ্যাচারিতে ৪৭টি কুয়ায় ২৪৯ বালতি। এছাড়া রাউজান উপজেলার মোবারক খিল হ্যাচারিতে ১৫টি কুয়ায় ১১৩ বালতি এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) এর পশ্চিম বিনাজুরি হ্যাচারিতে ১৩০ বালতি ডিম রাখা হয়েছে বলে জানান আইডিএফ’র প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. আব্দুল্লাহ আন নুর। প্রতি বালতি ৮-১০ কেজি ডিম ধারণ করতে পারে।
উদ্যোক্তা পর্যায়ে ১১টি ব্যক্তিগত হ্যাচারিতে ৩৩টি কুয়ায় ও সনাতন পদ্ধতিতে ৭৮টি মাটির কুয়ায় ডিম রাখা হয়েছে। ডিম থেকে রেণু পরিস্ফুটনের কাজে নিয়োজিত ডিম সংগ্রহকারীদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে বলে জানান হাটহাজারীর সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার মো. ফারুক মায়েদুজ্জামান।
প্রায় তিনযুগ ধরে ডিম সংগ্রহ করছেন কামাল উদ্দিন সওদাগর। তিনি বলেন, ডিম সংগ্রহ থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডিম নষ্ট হয়। সনাতন পদ্ধতির চেয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে হ্যাচারিতে ডিম ফোটালে ভালো ফল পাওয়া যায়।
তবে প্রয়োজনের তুলনায় সরকারি হ্যাচারির সংখ্যা খুব কম বলে জানান সংগ্রহকারীরা। আর বেশিরভাগ সময়ই থাকে অপরিচ্ছন্ন ও ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। যার কারণে মাছের ডিম রেণুতে পরিণত হওয়ার আগেই মারা যায়।
গত কয়েক বছর ধরে কম ডিম ছাড়ছে মা-মাছ। ২০২০ সালে হালদা থেকে ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়। পরের দুই বছর তা কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমে যায়। গত বছর বৃষ্টি না হওয়ায় ডিম ছাড়েনি মা মাছ। ৪৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়েছে সেবার। ২০২১ সালে বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল না নামার কারণে ডিম সংগ্রহ হয়েছে অল্প। সে সঙ্গে যুক্ত হয় ঘূর্ণিঝড়। তাই হালদা নদীর পানিতে বাড়ে লবণাক্ততা। তাই আশানুরূপ ডিম সংগ্রহ করা যায়নি। এরপর ২০২২ সালের ২২ মে মা-মাছ ডিম ছেড়েছিল।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহিদুল আলম বলেন, উপজেলা প্রশাসন হালদার মা মাছ, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। ভবিষ্যতেও হালদার প্রতি নজর থাকবে প্রশাসনের। এছাড়া ডিম ছাড়ার পর মা-মাছগুলো খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় যাতে কেউ মাছ শিকার ও কৃত্রিম রেণু বিক্রেতারা যাতে সক্রিয় হতে না পারে, সে লক্ষ্যে প্রশাসন কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করেছে। গত রোববার দিবাগত রাতে সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে মা মাছ। এবার ৩শ নৌকায় প্রায় সাড়ে ৯শ ডিম সংগ্রহকারী ১৮-২০ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করেছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তবে সরকারের নির্ধারিত কমিটি আগামী শুক্রবার যৌথ সভা করে সংগৃহীত ডিমের প্রকৃত হিসাব নির্ধারণ করবে।