চট্টগ্রাম, ৫ আগস্ট, ২০২৩:
টানা ভারী বর্ষণে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও বান্দরবানে পাহাড় ধসের আশঙ্কা বাড়ছে। একই সাথে পাহাড় ধসে পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারীদের প্রাণহানির আশঙ্কাও বাড়ছে। ইতিমধ্যে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে ভারী বর্ষণ আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে সারাদেশে বৃষ্টি হলেও চট্টগ্রামে বৃষ্টির মাত্রার সবচেয়ে বেশি।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শনিবার সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীতে।
এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার নগরীর টাইগার পাসে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে পাহাড় ধসে চাপা পড়ে একটি চলন্ত মাইক্রোবাস। যদিও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানায়, গত শুক্রবার থেকে জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে লোকজন সরিয়ে আনার কাজ শুরু করে। শনিবার চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান আকবরশাহ এলাকার বিজয় নগর ও ঝিল পাহাড়গুলোতে অভিযান চালিয়ে ২৫০টি পরিবারকে দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠান। এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরে ৬ টি সার্কেল এর মাধ্যমে ভাগ করে পাহাড় রক্ষায় ও মানুষের জানমাল রক্ষায় জেলা প্রশাসনের কয়েকটি টিম কাজ করছে। প্রতিদিন মাইকিং থেকে শুরু করে মানুষকে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে সরে যেতে নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, পাহাড়ে যাতে মানুষের আর প্রাণ না দিতে হয় সে জন্যে কাজ করছি। মাইকিং থেকে শুরু করে সকলকে সচেতন করার লক্ষে প্রতিদিন জেলা প্রশাসনের টিম কাজ করছে। আজকেও আমি নিজে ঝুকিপূর্ণ পাহাড় থেকে ২৫০ পরিবারকে সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়েছি। তাদের জন্যে শুকনো খাবার থেকে শুরু করে প্রতিবেলার খাবারের ব্যবস্থা করেছি। চট্টগ্রামের সকল পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত পরিবারকে ১৯ টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করার জন্যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী গত কয়েকদিন আগে বেলতলীঘোনায় পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বসবাসরতদের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।যারা পাহাড় কাটার সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা ও নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। পাহাড় রক্ষায় জেলা প্রশাসন চট্টগ্রাম জিরো টলারেন্স নিয়ে কাজ করছে ব্যক্তি বা সরকারি যার মালিকানায় পাহাড় থাকুক যারা পাহাড় কাটার সাথে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে। এর মধ্যে ১৭টি অতিঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫ পরিবার বসবাস করে। ১৭ পাহাড়ের মধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০ পাহাড়ে অবৈধভাবে বাস করছে ৫৩১ পরিবার। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাত পাহাড়ে বাস করছে ৩০৪ পরিবার। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছে জেলা প্রশাসন।
চট্টগ্রামে পাহাড় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত উপকমিটির তথ্যমতে, নগরের ২৫টি পাহাড়ে ১ হাজারেরও বেশি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কান্তি পাল জানিয়েছেন,
শহরে জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি খুবই খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা আছে। সমুদ্র বন্দরগুলোকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা এবং নদীবন্দরগুলোকে ১ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
টানা বর্ষণে বান্দরবানের থানচি সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে শুক্রবার সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা বন্ধ ছিল থানচি সড়ক। পাহাড়ধসে প্রাণহানির শঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে।
রাঙামাটির কাউখালীতে গত তিন দিন টানা বর্ষণের কারণে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে পাহাড়ধসের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে স্থানীয় সচেতন জনসাধারণ জানায়। যে কারণে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি ও মাইকিং করা হচ্ছে।
শনিবার সকাল থেকে রাঙামাটির কাউখারী উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের প্রশাসন ও রেডক্রিসেন্টের সদস্যরা মাইকিং সহ নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
ইতোমধ্যে উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত ২৬ টি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে ৩৬টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
কাউখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা সাদিয়া নূরীয়া তিনি বলেন, শনিবার সকাল থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে। এর মধ্যে আমরা পাহাড় ধস থেকে রক্ষা পেতে প্রশাসন পক্ষ থেকে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
রাঙামাটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, গত শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত রাঙামাটিতে ৭৭.২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া গতকাল শনিবার সকাল ৬টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ৩৭.৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার ২৪ ঘন্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল ৯৪ মিলিমিটার।
এর আগে ২০১৭ সালে ১৩ জুন রাঙামাটিতে ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় ৫ সেনাসদস্যসহ ১২০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে কাউখালী উপজেলাতে ২১ জনের প্রাণহানি ঘটে। সে বছর রাঙামাটি-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একটি অংশ ধসে সপ্তাহব্যাপী সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়েছিল। ২০১৮ সালে জেলায় নানিয়ারচরে ১২ জুন পাহাড় ধসে মারা যান আরো ১১ জন। এরপরের বছর জেলার কাপ্তাইয়ে মারা গেছেন তিনজন। যে কারণে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত হলেই রাঙামাটিতে পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দেয়।
অন্যদিকে রাঙামাটিতে জেলা প্রশাসন দুর্যোগ মোকাবেলায় জরুরি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকগণ ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা সর্বক্ষণ দুর্যোগ মোকাবেলায় নিয়োজিত আছেন। এদিকে জেলার ১০ উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের জরুরি কন্ট্রোল রুম খুলে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। শনিবার বিকালে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান শহরের রুপনগর,টিভি ষ্টেশন, লোকনাথ মন্দির,বিএম ইনষ্টিটিউট এলাকায় পাহাড়ধসের আশংকা আছে এমন আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে ঘর বাড়ি থেকে লোকজন নিরাপদে নিয়ে আসতে প্রশাসন মাঠে নেমেছেন। তার পরও লোকজন বাড়ি ঘর ছেড়ে আসছে না আশ্রয় কেন্দ্রে।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত সবাইকে ঝুকিপূর্ণ এলাকার ঘর বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে হবে। যে ভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে কেউ পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বাড়ি ঘরে থাকতে পারবেনা। তাই লোকজন সরিয়ে আনতে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, রেডক্রিসেন্ট যুবদল, রোভার স্কাউট ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের যুবকদের কাজে লাগানো হচ্ছে।
তবে রাঙামাটির জেলা প্রশাসকভারী বর্ষণের কারণে কাপ্তাই হ্রদে সব ধরনের নৌ যান চলাচল নিষিদ্ধ করেছেন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে কাপ্তাইয়েও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরে যেতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। কাপ্তাই উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে শত শত পরিবার ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে।
টানা তিনদিনের মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতে দ্বিতীয় দিনের মতো ডুবেছে চট্টগ্রাম নগরীর নি¤œাঞ্চল। শনিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ডুবেছিল অনেক এলাকা। এতে করে নি¤œাঞ্চলের বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছে পানি। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও পানি প্রবেশ করে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে এলাকার বাসিন্দাদের। বৃষ্টির সাথে সাথে রাস্তায় পানি উঠা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ার জন্য জোয়ারকে দুষছেন মেগা প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা।
বৃষ্টি হলেই রাস্তায় উঠছে পানি, দীর্ঘ হচ্ছে পানি জমে থাকার সময়ও। সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে দুর্ভোগ বাড়ছে নি¤œাঞ্চলের বাসিন্দাদের। এমনকি জলাবদ্ধতার কারণে শহরের একাংশের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে দীর্ঘ সময় ধরে। বৃষ্টিতে কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকা মোহরা, হামিদচর, চর রাঙামাটিয়া, চান্দগাঁও, বাস টার্মিনাল, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, খাজা রোড, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, শুলকবহর, বিবিরহাট, কাতালগঞ্জ, পাঁচলাইশ, প্রবর্তক মোড়, দেওয়ান বাজার, বাকলিয়া, মিয়াখান নগর, চকবাজার, কাতালগঞ্জ, কাপাসগোলা, বাদুরতলা, আগ্রাবাদ, সিডিএ আবাসিক এলাকা, শান্তিবাগ আবাসিক, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ, রিয়াজ উদ্দিন বাজারসহ নগরীর নিচু এলাকার সড়কগুলোতে হাঁটুপানি উঠেছে। অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায় জমে থাকা পানির উচ্চতা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সড়ক দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পোহাতে হয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগ। সড়ক ডুবে যাওয়ায় যাতায়াতে ব্যবহার করতে হচ্ছে রিকশা। এসব এলাকায় পানি প্রবেশ করার কারণ হিসাবে জোয়ারের পানিকে দুষছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রিগেডের পরিচালক কর্ণেল মো. শাহ আলী বলেন, বৃষ্টির পানি আটকে থাকার মূল কারণ জোয়ারের পানি। জোয়ারের পানি প্রবেশ করার কারণে বৃষ্টির পানি আটকে যাচ্ছে, নামতে সময় নিচ্ছে। জোয়ার না থাকলে কিন্তু পানি নেমে যাচ্ছে। একটু সময় নিলেও পানি আটকে থাকছে না, নেমে যাচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের প্রকল্পের পাঁচটি খালের মুখে স্লুইসগেট কার্যকর করা হয়েছে। সেখানে কিন্তু জোয়ারের পানি প্রবেশ করতে পারেনি। যার কারণে আগ্রাবাদ, সিডিএ আবাসিক এসব এলাকায় ঘরে পানি প্রবেশ করছে না। জোয়ার হলে তখন ওখানে বৃষ্টির পানি নামতে দেরি হচ্ছে। সেজন্য পানি উঠছে, কিন্তু জোয়ারের পানি প্রবেশ করতে পারেনি। খালের পানি নেমে যাওয়ার জন্য সব বাধ আমরা আগেই সরিয়ে নিয়েছি। কোনো খালের মধ্যে আমরা এখন কাজ করছি না।
কক্সবাজারে পাহাড়ে ঝুঁকিতে বসবাস করছে প্রায় তিন লাখ মানুষ। প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর পাহাড় দখল করে তারা বসবাস করছেন, যা কক্সবাজারে মোট বনভূমির এক-তৃতীয়াংশ। এর বাইরে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন ৪ হাজার ৮৫৮ হেক্টর জায়গায়। যে কারণে কক্সবাজারে পাহাড় ধস হলে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে স্থানীয় জনসাধারণ।
Discussion about this post