চট্টগ্রাম, ৫ অক্টোবর, ২০২১: সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের পুণ্যলগ্ন, শুভ মহালয়া আজ বুধবার। হিসাব অনুযায়ী, আজ থেকেই শুরু দেবীপক্ষের।
পুরাণ মতে, এ দিন দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে। আর বাংলার আকাশে-বাতাসে উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে দুর্গাপূজা। অশুভকে বধ করে শুভশক্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শারদীয় দুর্গোৎসব এখন সার্বজনীন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎসবমুখর পরিবেশে পূজা উদযাপনের প্রস্তুতি সর্বত্র, সারাদেশে চলছে।
মহালয়া থেকে দুর্গাপূজার আগমনী ধ্বনি শোনা যায়। মহালয়া এলেই দেবী বন্দনার সুর বাংলার হৃদয়ে ধ্বনিত হয়। ঢাকের আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসে। বুকে জাগে আনন্দ শিহরিত কাঁপন- ‘মা আসবেন’। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’- এই মনোভাব নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ব বৃহৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠান শরৎকালীন দুর্গাপূজা। সার্বজনীন উৎসব। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ আর উপভোগে সফল উৎসব।
শ্রী শ্রী চ-ীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আবাহনই মহালয়া হিসেবে পরিচিত। শারদীয় দুর্গাপূজার একটি গুরুত্বপর্ণ অনুষঙ্গ হলো এই মহালয়া।
পুরান মতে, মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। শিবের বর অনুযায়ী কোনও মানুষ বা দেবতা কখনও মহিষাসুরকে হত্যা করতে পারবে না। ফলত অসীম ক্ষমতাশালী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে এবং বিশ্বব্রহ্মা-ের অধীশ্বর হতে চায়।
মহামিলনের উৎসব এবং মহাশক্তির জাগরণের ঐকান্তিক আরাধনা শারোদৎসবের সাথে, মহালয়ার পিতৃতর্পণের দিনটির আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে। পিতৃতর্পণ প্রিয়জনের বিয়োগ ও বেদনার প্রকাশ এবং শারোদোৎসব হল- দেবী দুর্গার মাতৃরূপের আরাধনার মাধ্যমে বিজয় উৎসব পালন।
‘তর্পণ’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ জল প্রদান করা। হিন্দু শাস্ত্রে উল্লিখিত আছে, তর্পণ হল এমন এক যজ্ঞ যাতে পিতৃপুরুষের জন্য আহুতি দিয়ে তাদের আত্মার তৃপ্তিসাধন এবং ফলশ্রুতি স্বরূপ তর্পণকারী ব্যক্তিকে পিতৃপুরুষ সুখ ও অনাবিল জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করেন। ‘মনুস্মৃতি’ গ্রন্থে তর্পণকে পিতৃযজ্ঞের সমান মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে।তর্পণের সংজ্ঞা ও তর্পণযোগ্য পিতৃপুরুষ ‘তৃপ্যান্তি পিতরো যেন তৎপনয়’ অর্থাৎ মৃত পিতৃপুরুষ যে বস্তু প্রদানে প্রসন্ন হন তাকেই তর্পণ বলে। আমদের নিজস্ব বংশজাত মৃত পিতৃপুরুষের দেহে যে আত্মার অবস্থান ছিল বর্তমানে তারা যে শরীরেই থাকুন না কেন, সেই শরীরেই শাস্ত্রোক্ত জলক্রিয়া ও শ্রাদ্ধকর্ম দ্বারা তিনি তৃপ্তিলাভ করে থাকেন। কারণ তর্পণের ফলে, তর্পণযোগ্য দ্রব্যের সূক্ষ্ম পরমাণু মন্ত্র বলে তার বর্তমান দেহের ভক্ষ্যবস্তুর পরমাণুর সাথে মিশে যায়।
কালের অববাহিকাতে আর্য ঋষিরা তাদের দূরদৃষ্টিতে ভবিষ্যতের ধ্বংসের পরিণাম দর্শন করেছিলেন এবং বেদের যুগে মঘা নক্ষত্রে বিষুব মিলনকালীন সূর্যকেই পিতৃগণ নামে স্তব ও আরাধনা করেছিলেন। তারপরে অতীতকালের কোন এক ভাদ্রমাসের অমাবস্যার ১৪ দিন পূর্ব থেকে, সূর্যের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য প্রদান করে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে উপাসনা প্রথার প্রচলন করেছিলেন। পরবর্তীকালে ‘পিতৃগণ’ নামধারী সূর্যার্ঘ্য দান, পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণে রূপান্তরিত হয়েছে। বেশিরভাগ শাস্ত্রজ্ঞ প-িতের মতে- প্রতি বছরের ভাদ্র মাসের পুরো কৃষ্ণ পক্ষটিই ‘পিতৃপক্ষ’ যা সাধারণতঃ ১৪ দিনের অবধিকাল।
কপিল মুনি রচিত সাংখ্য দর্শন এর মতে প্রকৃতি থেকে এই জগৎ সৃষ্টির প্রথম ব্যক্ত রূপ হলেন ব্রহ্মা, যার দার্শনিক নাম ‘মহান’। এই ‘মহান’ থেকেই অহংকার, মন, পঞ্চভূত, ইন্দ্রিয় সবকিছু একের পর এক সৃষ্টি হয়। তেমনই যখন কারোর মৃত্যু হয় বা ‘লয়’ হয় তখন বিপরীত প্রক্রিয়ায় মন সহ সমস্ত ইন্দ্রিয় একে একে পঞ্চভূতে লীন হয়, পঞ্চভূত হচ্ছে (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম), পঞ্চতন্মাত্রে (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) বিলীন হয়, তা পুনরায় বিলীন হয় অহংকারে। অবশেষে অহংকার বিলীন হয় ‘মহান’এর মধ্যে। এখানে বিলীন হওয়া মানেই মৃত্যু।
মহানের মধ্যে লয়প্রাপ্ত হওয়াটাই ‘মহালয়া’ যা থেকে এসেছে স্ত্রীলিঙ্গতে ‘মহালয়া তিথি’।
হিন্দু দর্শন মতে, মহালয়া তিথিতে, ভগবান ব্রহ্মার নির্দেশে প্রয়াত পিতৃ পুরুষেরা সূক্ষ্মদেহে নেমে আসেন মর্ত্যভূমির পরিম-লে। অর্থব বেদে উল্লিখিত আছে- ‘বিধু ঊর্ধ্বভাগে পিতরো বসতি’ অর্থাৎ চন্দ্রের (সংস্কৃত অর্থে বিধু এর অর্থ চন্দ্র) অপরপৃষ্ঠে যা পৃথিবী থেক দৃশ্যমান নয়, তাতে আমাদের পিতৃপুরুষরা বিরাজ করেন। মহালয়ার দিন প্রয়াত পিতৃপুরুষদের মহান (বিশাল) সমাবেশ (আলয় বা আবাস) অন্তরীক্ষে তৈরি হয় বলেই দিনটির নাম ‘মহালয়া’। মহালয়াতে শ্রাদ্ধ করাটা এতই পূর্ণ্যকর্ম যে, এই শ্রাদ্ধে নাকি গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধ করার ফল মেলে। কিন্তু মহালয়ার সার্বিক বিশিষ্টতা হল ‘তর্পণ’।
দেবী দুর্গার আগমনী মহালয়া উপলক্ষে আজ ভোর ৫টা থেকে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন মন্দিরে চ-ীপাঠের আয়োজন করা হয়েছে। সকালে মহালয়ার পূজা ছাড়াও রয়েছে-মহালয়ার বিশেষ অনুষ্ঠান।
এ বছর চট্টগ্রাম নগরীতে ২৭৩ ম-পে শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করা হচ্ছে। ১০ অক্টোবর দুর্গাপূজার পঞ্চমী, ১১ অক্টোবর ষষ্ঠী। ১৫ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে দেবিদুর্গার নিরঞ্জন অনুষ্ঠিত হবে।
Discussion about this post