চট্টগ্রাম, ৮ অক্টোবর, ২০২১: আজ শেষ হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের (কর্ণফুলী টানেল) দ্বিতীয় চ্যানেলের সুরঙ্গ খননের কাজ । পোর্ট নসটি লিঙ্ককে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন- কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম।
গত বছর ১২ ডিসেম্বর আনোয়ার প্রান্ত থেকে টানেলের দ্বিতীয় টিউব(দ্বিতীয় চ্যানেল) খননের কাজ শুরু হয়। প্রথম টিউব থেকে ১২ মিটার দূরে স্থাপন করা হয়েছে দ্বিতীয় ও শেষ টিউবটি।
গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, অন্যতম মেগা ও স্বপ্নের প্রকল্প বঙ্গবন্ধু টানেলের দ্বিতীয় চ্যানেলের মুখ শুক্রবার রাতে খুলে দেওয়া হবে। আগেই খুলে দেওয়া হয়েছিল একটা চ্যানেলের মুখ। শুক্রবার মধ্যরাতে শেষ হবে দুটোর নির্মাণকাজ। তিনি আরও জানান, আগামী বছরের ২২ ডিসেম্বর টানেল চালুর কথা ছিল। এখন মনে হচ্ছে এরও আগে এটা চালু করতে পারবো। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত কর্ণফুলী টানেলের কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ নিয়েছেন।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকায় নির্মাণ করা হচ্ছে ৩ হাজার ৫ মিটার দীর্ঘ টানেল। দেশের প্রথম টানেল প্রকল্প এটি। টানেলটি চট্টগ্রামের নেভাল একাডেমি পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে কাফকো ও সিইউএফএল পয়েন্টের মাঝখান দিয়ে অপর প্রান্তে যাবে। নদীর তলদেশে সর্বনিম্ন ৩৬ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১০৮ ফুট গভীরে স্থাপন করা হবে দু’টি টিউব। এছাড়া প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নগরের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত চার লেনের ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ টানেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সম্পন্ন হয়েছে।
নগরীর পতেঙ্গা ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী এই টানেলের নির্মাণকাজ ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর টানেলের বাম সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। নির্ধারিত সময়সূচি অনুসারে ২০২১ সালের নভেম্বরে উভয় সড়ক এবং ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
টানেলটি নির্মিত হলে কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, নৌ বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে।
জানা গেছে, চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে এই প্রকল্পের কাজ করছে। ৯ হাজার ২৯৩ মিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট রাস্তাসহ প্রকল্পটি দ্বিমুখী চারলেন মডেল অনুসরণ করে নির্মিত হচ্ছে। ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মূল টানেলের সঙ্গে পতেঙ্গা এবং আনোয়ারা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মিত হচ্ছে। সংযোগ সড়ক ও টানেলের ভেতরের সড়ক হবে সর্বমোট ৪ লেনের। এর মধ্যে ওয়ান ওয়ে একটি টানেলে সড়ক থাকবে দুই লেনের।যেখানে মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ হাজার ৩১৫ মিটার। ফ্লাইওভার ও সংযোগ সড়ক যথাক্রমে ৭২৭ মিটার এবং ৫ হাজার ৩৪১ মিটার। দুই টিউবের এই টানেল নির্মাণকাজ শেষ হলে ৪ লেন দিয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চলাচল করতে পারবে।এ ছাড়া টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার এপ্রোচ রোড এবং ৭২৭ মিটার ওভার ব্রিজ সম্পন্ন টানেলটি চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করবে।এর মধ্যে আনোয়োরা প্রান্তে ৭০০ মিটারের একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে, যা আনোয়ারা চাতুরী চৌমুহনীতে এসে চট্টগ্রাম আনোয়ারা বাঁশখালী পিএবি সড়কের সঙ্গে মিলিত হবে।
মিয়ানমার হয়ে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্তিসহ ৭টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যকে এগিয়ে নেয়ার জন্য টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
গত মঙ্গলবার পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছিলেন, আগামী বছরের ২২ ডিসেম্বর এটি চালুর কথা ছিল। কিন্তু সবার জন্য আনন্দের ব্যাপার যে তারও আগেই এটা চালু করতে পারব।
কর্ণফুলী নদীর পানির স্তরের ৪৫ মিটার গভীর দিয়ে হচ্ছে এই টানেল। চীনের অর্থায়নে টানেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৭০৫ মিলিয়ন ডলার। জমি অধিগ্রহণ এবং প্রশাসনিক ব্যয় বহন করছে বাংলাদেশ সরকার।
টানেলকে ঘিরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হবে।
একটি টিউবের সড়ক দিয়ে আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গা অভিমুখী এবং অপর টিউব দিয়ে পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা অভিমুখী যানবাহন চলাচল করবে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে প্রতিটি টিউব চওড়া ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট এবং উচ্চতা ৪ দশমিক ৮ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। একটি টিউব থেকে অপর টিউবের পাশাপাশি দূরত্ব প্রায় ১২ মিটার। টানেলের প্রস্ত ৭০০ মিটার। এবং দৈর্ঘ্য তিন হাজার ৪০০ মিটার।
২০০৮ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে কর্ণফুলীতে টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে প্রস্তাবটি প্রকল্প আকারে উত্থাপন করা হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই রিপোর্ট চূড়ান্ত হওয়ার পর স্থান নির্বাচন নিয়ে কেটে যায় আরও দুই বছর। ২০১৪ সালের শেষ দিকে এসে কর্ণফুলীর মোহনায় টানেল নির্মাণে একমত হন নগরবিদ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শক ও সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা।
টানেল নির্মাণে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে চীনা কোম্পানি চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানির (সিসিসিসি) সঙ্গে সমঝোতাস্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যৌথভাবে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পসহ মোট ৬টি প্রকল্পের ভিত্তিফলক উদ্বোধন করেন।
টানেল নির্মাণে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় সিসিসিসি। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এরই মধ্যে চীন অর্থায়ন করছে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিচ্ছে। বিশ্ব দেখবে সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম।
এ প্রকল্পে দেশি-বিদেশি প্রায় এক হাজার ২০০ লোক তিন শিফটে কাজ করছেন। এদের মধ্যে ৩০০ জন চীনা শ্রমিক আছেন। প্রতিদিন তিন শিফটে কাজ চলছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, টানেল দিয়ে বছরে প্রায় ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। চালুর তিন বছর পর ওই সংখ্যা দাঁড়াবে ৭৬ লাখে। চালুর প্রথম বছরে চলাচল করা গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ হবে কন্টেইনারবাহী ট্রেইলর এবং বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও ভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস, মিনিবাস ও মাইক্রোবাস এবং ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ছোটগাড়ি থাকবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, টানেল নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলেই চট্টগ্রাম মহানগরীর পাশাপাশি নদীর অপর তীরে আনোয়ারা-কর্ণফুলী এলাকায় গড়ে উঠবে আরও একটি নতুন শহর। নতুন এই শহরের অবকাঠামো একের পর এক নির্মিত হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছিলেন, শুক্রবার মধ্যরাতে এর দ্বিতীয় মুখ উন্মোচন করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘তবে এখনই পরিবহন যাতায়াত করতে পারবে না। পুরোপুরি সম্পন্ন করতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে।
Discussion about this post