চট্টগ্রাম, ২৯ অক্টোবর, ২০২১
সারাদেশে সনাতনী সম্প্রদায়ের মঠ মন্দির, দেবালয়, প্রতিমা ভাংচুর, বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুন্ঠন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ইসকন নোয়াখালী মন্দিরে সাধু-সন্ন্যাসীদের হত্যাসহ দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবামৃত সংঘ-ইসকন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার সমাবেশ করেছে। বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) নগরীর নন্দনকানন চত্বরে এ মহাসমাবেশের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন), চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটি।
মহাসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ইসকনের সাধারণ সম্পাদক শ্রীপাদ চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী। দুপুর ১২ টায় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মুল অনুষ্ঠানমালা শুরু হয়।
সভায় সংহতি প্রকাশ করে সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৭২’র সংবিধান ফিরে যেতে হবে। সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। আর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করতে হবে। সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত, হামলাকারী ও উসকানিদাতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি নিশ্চিত করলে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি রোধ হবে।
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালাম বলেন, এই সম্প্রীতি সমাবেশ প্রমাণ করেছে বীর চট্টলায় সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। হিন্দু, মুসলমি, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান আমরা সকলেই একই রক্তের মানুষ। আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। আমরা সবাই বাঙালি। সংখ্যালঘু বলা সংবিধান পরিপন্থী।
দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা সাম্প্রদায়িকতাা প্রতিরোধে ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় জনমত গড়ে তুলবো।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির বলেন, অসাম্প্রদায়িক দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই। সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় আপনাদের মতো আমিও ব্যথিত। জননেত্রী শেখ হাসিনা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক। যেখানে সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেখানে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামেও যেখানে ঘটনা ঘটেছে, আমি নিজে ছুটে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছি। আপনাদের ক্ষোভ আমি বুঝি, আপনাদের দুঃখ কষ্ট আমি বুঝি। আমি আপনাদের সঙ্গে আগেও ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো।
অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা একটি কথা বলতে অভ্যস্ত। বাংলাদেশে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি আছে তা পৃথিবীর কোন জায়গায় নাই। আমি বলব সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ ভাবে সংবিধানকে সাম্প্রদায়িকরণ করে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিষ্টানে ভাগ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করেছে। আমরা সরকারি দলের মধ্যে একটা আত্মশুদ্ধি চাই। এ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর ৭১ এর আওয়ামী লীগ কিনা আমরা জানি না। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে আওয়ামীলীগ ক্রমশ ১৯৪৮ সালের আওয়ামী মুসলিম লীগের দিকে চলে যাচ্ছে। ওই আওয়ামী মুসলিম লীগ দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় নাই। প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কোন রাজনীতিবিদদের ওপর আমাদের আস্থা নাই। আগামী দেড় দুই বছর আমরা ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের নানাবিধ সংগঠন যুক্তভাবে আমরা মাঠে থাকব। নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে। সময় আছে দেড় বছর। আমরা মাঠে আছি মাঠে থাকব। মাঠ ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাব না।
বিএনপির মহানগর সভাপতি ডা.শাহাদাত হোসেন বলেন, বিএনপি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। হামলার ঘটনায় যারা প্রকৃত জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। নিরাপরাধ কাউকে যেন গ্রেপ্তার করা না হয় বা ঘটনা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেরা না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। আসুন সকলে মিলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, বঙ্গবন্ধু তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি এটি আমাদের মাতৃভূমি হলেও একদিন হয়ত আমরা এদেশে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব। বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা এখনো অটুট। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি আমাদের আস্থা আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। আমরা চাই, সকল সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের মাধ্যমে বিচার হোক, ক্ষতিগ্রস্ত মঠ-মন্দির রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পুননির্মান হোক ও সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন মহান জাতীয় সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হোক। এছাড়া সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় জড়িত ও উসকানিদের শাস্তি ফাঁসি করার দাবি জানান বক্তারা। সমাবেশ শেষে একটি শান্তিপুর্ন পদযাত্রা চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব চত্বরে সমাপ্ত হয়। সমাবেশে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা হতে পাঁচ শতাধিক সংগঠন যোগদান করেন।
সমাবেশে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে দলে দলে সনাতনীরা প্ল্যাকার্ড, জাতীয় পতাকা, গৈরিক পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুনসহ নানা শ্লোগানে সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। লাখো জনতার অংশগ্রহণে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে নন্দনকানন, ডিসি হিল প্রাঙ্গণ, বৌদ্ধবিহার সড়ক, তুলসীধাম সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক।
এরপর বৈদিক স্বস্তিবাচনের পরপরই স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইস্কন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ শ্রীপাদ লীলারাজ গৌর দাস ব্রহ্মচারী এবং দিক নির্দেশনামূলক ও দাবি সম্বলিত বক্তব্য রাখেন ইসকন চট্টগ্রামের বিভাগীয় সম্পাদক শ্রীপাদ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী। মহাসমাবেশে মহাআর্শিবাদক ছিলেন শংকর মঠ ও মিশনের আচার্য শ্রীমৎ তপনানন্দ গিরি মহারাজ, শ্রী শ্রী তুলসীধামের মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ দেবদ্বীপ মিত্র পুরী মহারাজ, চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের উপাধ্যক্ষ ড. জিন বোধি ভিক্ষু, পাথরঘাটা ক্যাথলিক চার্চের ফাদার মিস্টার লেনার্ড। ইসকন সদস্য স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী।
সভায় অন্যদের মধ্যে সংহতি প্রকাশ করেন- জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)র ইন্দু নন্দন দত্ত, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ পালিত, ইসকন কো রিজিওনাল সেক্রেটারি শ্রীপাদ রাধা গোবিন্দ দাস ব্রহ্মচারী প্রমুখ।
উল্লেখ্য, এবারের শারদীয় দুর্গোৎসবের অষ্টমীর দিন বুধবার কুমিল্লার একটি মন্দিরে ‘কোরআন অবমাননার’ কথিত অভিযোগের ছবি-ভিডিও ফেইসবুকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মন্দিরে হামলা হয়, যা থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে।
কুমিল্লায় নানুয়া দিঘীর পাড়ে একটি পূজামণ্ডপের ঘটনার সূত্রপাত হলেও বিকাল পর্যন্ত আরও কয়েকটি মন্দির ও মণ্ডপে হামলা হয়। চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, মৌলভীবাজার, গাজীপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ আরও কয়েকটি জেলায় একই ধরনের ঘটনা ঘটে।বিজয়া দশমীর দিনে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে কয়েকটি পূজামণ্ডপ এবং হিন্দুদের বাড়িঘরে দফায় দফায় হামলা-ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের পর ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। চট্টগ্রামেও জেএমসেন হলের কেন্দ্রীয় দুর্গাপূজার মণ্ডপে দশমীর দিন হামলা করে বাইরের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা ও জেএমসেন হলের গেইট ভাঙ্গার চেষ্টা করে।
Discussion about this post