চট্টগ্রাম, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১ :
শেফালি ঘোষের আঞ্চলিক গানের সেই সোনাদিয়া দ্বীপ। ‘তুঁই যাইবা সোনাদিয়া বন্ধু, মাছ মারিবার লাই’। এখন সোনাদিয়া দ্বীপে শুধু মাছ মারার জন্য নয়, পর্যটকরাও নিয়মিত যাতায়াত করছেন।
সোনাদিয়া দ্বীপটি কক্সবাজার শহর থেকে সাত কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সাগরগর্ভে অবস্থিত। তিন দিকে সমুদ্রসৈকত ঘেরা দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৯ বর্গকিলোমিটার।
এক সময় জেলেরা শুধু মাছ ধরার জন্যই এই দ্বীপে যেতেন। এরমধ্যে রূপে আরও অপরূপ হয়ে উঠেছে সোনাদিয়া দ্বীপ। যান্ত্রিক জলযানের গতি বেড়েছে। মানুষের অর্থনৈতিক সার্মথ্যও বেড়েছে। যে কারণে সোনাদিয়া দ্বীপে পর্যটকরা যাতায়াত শুরু করেছে।
সোনাদিয়া কিন্তু কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মত সাগর সৈকত নয়। সোনাদিয়া মূলত সাগরলতায় ঢাকা বালিয়াড়ি, কেয়া-নিশিন্দার জঙ্গল, ছোট-বড় খালে ঘেরা প্যারাবন। এটি কক্সবাজারের মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন। এই দ্বীপে ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। সেখানকার সাগরের পানি কক্সবাজারের মতো ঘোলা নয়, গভীর এবং নীল। এই দ্বীপে প্রচুর লাল কাঁকড়া ও পরিযায়ী পাখি দেখতে পাওয়া যায়।
কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউপির দক্ষিণে অবস্থিত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর অপার এক সম্ভাবনাময় উপদ্বীপ সোনাদিয়া। এই দ্বীপ ভ্রমণে স্থানীয়দের চাহিদা থাকলেও দিন-দিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শীতের শুরুতে দেশি বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। রাত্রি যাপনের সুযোগ থাকায় শুধু স্থানীয়রা নয়, দূরের পর্যটকরাও বেড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এই দ্বীপে। তারা দেখার সুযোগ পান পড়ন্ত বিকেলের সাগরের সূর্য ডোবার দৃশ্য, সন্ধ্যার গোধূলিমাখা আকাশ, রাতের দৃশ্যসহ অনেক কিছু দেখা থেকে বঞ্চিত হত পর্যটকেরা। তবে ঢাকার একদল পর্যটক তা মিস করেননি। তারা তাঁবু টাঙিয়ে রাত্রি যাপন করে সোনাদিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
আগেকার সময়ে সকালে গিয়ে বিকেলেই ফিরে আসতেন পর্যটকেরা। এখন রাত কাটানোর ব্যবস্থাও হয়েছে স্থানীয় একটি টুরিস্ট গাইড দলের কারণে।
এ বছর বিজয় দিবসের ৩ দিনের ছুটিতে অনেক পর্যটক গেছেন সোনাদিয়া ভ্রমণে। কক্সবাজার এসে ১৮ ডিসেম্বর সোনাদিয়া পাড়ি জমান তারা। রাত্রি যাপনের সুযোগ-সুবিধা না থাকায়, প্রস্তুতি নিয়ে এসে রাত্রি যাপন করেন তারা। কনকনে শীত উপেক্ষা করেই রাত্রি যাপন করেন তারা।
স্থানীয়রা জানান, শীতের মৌসুমে পর্যটকের ভিড় জমে সোনাদিয়ায়। সেখানে পর্যটকদের থাকার সুযোগ-সুবিধা তেমন না থাকলেও স্থানীয়ভাবে পর্যটকদের নিরাপত্তা দেওয়াসহ অস্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
কিছু দিন আগে ঘটিভাঙ্গার একদল তরুণ একটি ট্যুরিস্ট গাইড গঠন করে। তারা মূলত পর্যটকদের গাইড সহ রাত্রি যাপন ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে আসছে। পর্যটকের জন্য গত বছর থেকে ঘটিভাঙ্গার স্থানীয় যুবকরা গড়ে তুলেন সেন্টি হিল বিচ নামক একটি টুরিস্ট গাইড, তারা মূলত অনলাইনে পর্যটকদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে নিরাপদে ভ্রমণ করার সকল সুযোগ সুবিধা তারা দিয়ে থাকেন।
স্যান্ডি হিল বিচের পরিচালক মি ফরহাদ জানান, মাত্র ৯৫০ টাকায় সোনাদিয়া দ্বীপে জনপ্রতি ক্যাম্পিং প্যাকেজ করতে পারে। প্যাকেজে থাকবে- তাঁবু, ফোমের বেড, বালিশ, কম্বল। রাতে খাবার থাকবে- বার বি কিউ অথবা ভাত, ভর্তা, মুরগি, ডাল। সকালের নাস্তা- ডিম, খিঁচুড়ি। দুপুরে খাবার- ভাত, ডাল, সামুদ্রিক মাছ, ভর্তা। প্যাকেজে থাকবে বোট সার্ভিস (ঘটিভাঙ্গা টু সোনাদিয়া)। ক্যাম্পিং-এ কোন প্রকার মাদকদ্রব্য বহন বা সেবন করা যাবে না।
সোনাদিয়াকে ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য এই দ্বীপের ৯ হাজার ৪৬৭ একর জমি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) বরাদ্ধ দিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
বেজা সোনাদিয়া দ্বীপে পর্যটকদের জন্য পর্যটনকেন্দ্র, আবাসিক এলাকা, আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে সরকারের কাছ থেকে এই জমি বরাদ্ধ নিয়েছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সেখানে পর্যটন শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে সংস্থাটির। সরকারিভাবে এই দ্বীপে পর্যটন শিল্প গড়ে তুলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
কক্সবাজার থেকে সরাসরি সাগর পথে যাওয়া যায়, আবার মহেশখালী এসে ঘটিভাঙ্গা ঘাট থেকে বোটে করে সোনাদিয়া যাওয়া যায়।
সোনাদিয়া যাওয়ার পথে দুই পাশের সবুজ বেষ্টনী দেখতে ভালো লাগে। ছোট ছোট নৌকায় জেলেদের মাছ ধরা, প্যারাবনে মহিষের পালের হেঁটে যাওয়া এসব মুগ্ধ করে রাখে। আর তা দেখতে সোনাদিয়া দ্বীপে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক যাচ্ছে বছরের বিভিন্ন সময়ে।
Discussion about this post