চট্টগ্রাম, ৬ ডিসেম্বর, ২০২২
বাংলা আধুনিক গানের অমর শিল্পী সুর স¤্রাজ্ঞি লতা মঙ্গেশকর। তার মৃত্যুতে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ টুইটারে লিখেছেন, লতাজির মৃত্যু আমার জন্য হৃদয়বিদারক, যেমন এটি বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য। তার গানের বিশাল পরিসরে, ভারতের সারমর্ম এবং সৌন্দর্যকে উপস্থাপন করে, প্রজন্ম তাদের হৃদয়ের আবেগের প্রকাশ খুঁজে পেয়েছে। একজন ভারতরতœ, লতাজির কৃতিত্ব অতুলনীয় থাকবে।
এই অতুলনীয় শিল্পী লতা মঙ্গেশকর ভারতের ৩৬ টি ভাষায় গান গেয়েছেন। ভারতের লোক সংখ্যা যদি ১৩০ কোটি হয়, আর বাংলা ভাষী মানুষ মিলে সারা পৃথিবীতে যদি ২০০ কোটি মানুষও হয় তাহলে তাদের মধ্যে লতা মঙ্গেশকরের গান শুনেনি এমন কোনো মানুষ হয়ত পাওয়া যাবে না। যেমনি বাংলা ভাষী দুই বাংলার কোনো মানুষ লতার গান শুনেনি এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। ঠিক তেমনি ভারতের অন্যান্য ভাষাভাষীদের ক্ষেত্রেও। আর শুধু গান গাইলেই শিল্পী হয় না। সেই গানের শ্রোতা প্রয়োজন হয়। কিন্তু লতার গান শুনে শুনেই শ্রোতারা তার গান শোনার জন্য উন্মুন হয়েছে। এ কারণে কোটি কোটি মানুষ লতার গানের ভক্ত।
সেই সোনালী সময়ের গান বলতে যেসব ভারতীয় শিল্পীদের বোঝাত তাদের মধ্যে লতা মঙ্গেশকর সেরাদের একজন। সেই সেনালী সময়ের শিল্পীদের মধ্যে আজও সবচেয়ে জনপ্রিয়। তার গানের সুর কানে আসলেই মানুষ কান পেতে শুনে। সেই কান পেতে শোনা শ্রোতারা সব শ্রেণি-পেশার। সব বয়সের। কয়েক প্রজন্ম ধরে শুনছে সেই গান। যে গান পুরনো হয়নি। বরং শুনে শুনে শ্রোতার বিস্ময় প্রকাশ করেছে। যেন চিরকালের এক শিল্পী তিনি। চিরকালের কিনা সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু তিনি যে কয়েক প্রজন্মেও শ্রোতাদেও কাছে উচুঁমাপের শিল্পী ছিলেন সেটা মোছা যাবে না।
ফেসবুকে অনেকে লিখেছেন, লতা মঙ্গেশকরের গান আরও অন্তত ১০০ বছর শ্রোতারা শুনবে। সেই অতুলনীয় কণ্ঠে তিনি গেয়েছেন। যা ঐশ্বরিক কণ্ঠই বলেছেন বোদ্ধারা।
লতা মঙ্গেশকরের জন্ম ১৯২৯ সালে ২৮ সেপ্টেম্বও ভারতের ইন্দোর শহরে। মৃত্যু হলো ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি। লতা তার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯৪২ সালে মারাঠি গান গেয়ে। প্রথম হিন্দি সিনেমায় গান করেন ১৯৪৬ সালে। প্রায় ৭ দশক ধরে তার বিশাল বিস্তৃত গানের ক্যারিয়ার। লতার পিতা
শিল্পীর প্রয়াণে দু’দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে ভারত সরকার। এই দু’দিন অর্ধনমিত থাকবে তাদের দেশের জাতীয় পতাকা। শোক জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্রমোদি। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। শোকে বিহ্বল ভারতের গোটা সাংস্কৃতিক জগত। বলিউড থেকে শুরু করে টালিউডের গোটা শিল্পী সমাজ।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শোক প্রকাশ করেছে এই সুর স¤্রাজ্ঞির মৃত্যুতে।
লতা মঙ্গেশকর করোনা আক্রান্ত হয়ে মুম্বইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছিলেন । সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন গত মাস থেকে। চিকিৎসায় শারীরিক অবস্থার মাঝে মাঝে উন্নতি হলেও গত শনিবারই তার স্বাস্থ্যের বেশ অবনতি হয়। তখন তাকে আবার ভেন্টিলেশনে নেয়া হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে আর ফেরানো যায়নি। আজ রবিবার সকালেই মারা যান তিনি।
লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে প্রথমে তার বাড়ি ‘প্রভুকুঞ্জে’ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ভারতীয় জাতীয় পতাকায় ঢাকা মরদেহ শেষ বিকালে শিবাজি পার্কে নেওয়া হয়। সেখানে এক ঘণ্টার বেশি সময় তার মৃত দেহ রাখা হয়। সেখানে সব শ্রেণিপেশার জনগণ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। এর আগে ভারতরতœ খেতার পাওয়া এই শিল্পীকে শেষবিদায় জানাতে অশ্রুসিক্ত নয়নে অপেক্ষায় ছিলেন হাজার হাজার ভক্ত। সেখানে শিবাজিপার্কে উড়োজাহাজে পৌঁছে যান আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শিবাজি পার্কে গিয়ে লতা মঙ্গেশককে শেষ শ্রদ্ধা জানা ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সর্বশেষ ভারতের তিন বাহিনীর সদস্যরা লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহের রাষ্ট্রীয় সম্মান জানান। তার মহাশ্মশানে মহা প্রস্থানের পর্ব।
৩৬টি ভাষায় ৩০ হাজারের বেশি গান গাওয়া লতাকে দাদা সাহেব ফালকে, পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, সব্বোর্চ ভারত রতœ খেতাব দিয়ে সম্মানিত করে ভারত। ভারতের সবচেয়ে চাহিদা সম্পন্ন শিল্পী ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। বলিউডের সকল সেরা শিল্পীরা চাইতেন তাদের প্লেব্যাক শিল্পী যেন লতা মঙ্গেশকরই হন।
।
‘গজাবাউ’ নামে এক মারাঠি সিনেমায় ১৯৪৩ সালে ‘কিছু কথা, কিছু শব্দ’ গান গেয়ে শুরু হয় চলচ্চিত্রে তার প্রথম প্লেব্যাক। এছাড়া প্রায় আটটি মারাঠি সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। ১৯৪৬ সালে প্রথমে হিন্দি সিনেমায় গান করেন তিনি।
১৩ বছরে বাবাকে হারানো লতা নিজের ভাই বোনদের দেখাশুনা করার জন্য নিজে আর বিয়েশাদিও করেননি। মূলত তার ধ্র্রুপদ শিল্পী পিতা দীনানাথ মুঙ্গেশকর মারা যাবার পরই তাকে সিনেমা ও পেশাদার সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে যাত্রা করতে হয়। আর তার গানের হাতে খড়ি শুরু হয়েছিল তার পিতার হাতেই। যখন তিনি মাত্র মাসে ২ শ’ রুপি রোজগার করতেন। তা দিয়েই চলত তাদের মা ও পাঁচ ভাইবোনের ভরণপোষণ।
সংগীত পরিচালক আর চলচ্চিত্র প্রযোজকদের নয়নের মনি লতায় বাংলা সিনেমায় প্রায় ২০০ গান গেয়েছেন। বাংলাদেশের একটি সিনেমায়ও প্লেব্যাক করেছেন তিনি। প্রয়োজন অনুযায়ী গায়কী আর কণ্ঠে বদলে নেওয়ার অসাধারণ প্রতিভার এই শিল্পী সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক নওশাদ আলী বলেছিলেন, ‘লতার মত সংগীত প্রতিভা আমি আর পাইনি। বিভিন্ন মাধ্যমেই এক একজন আসেন, যার মাথায় ঈশ্বর হাত রাখেন, লতা তেমনই একজন।’
লতার সুরেলা কণ্ঠ এবং আন্তরিক গান গাওয়াকে গীতিকার এবং চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার বলেছেন, ‘’এতোটাই বিশুদ্ধ এবং পরিষ্কার যেন স্ফটিকের সবচেয়ে সেরা মুক্তো।’
মূলত সাধনা ও সংগ্রাম লতা মঙ্গেশকরকে অমরত্ব দিয়েছে। বহু প্রজন্মের স্বপ্নের ভুবন তৈরি হয়েছে তার গানে গানে। তাই ‘যারে উড়ে যারে পাখি’টির মত প্রাণের মেলা ফুরিয়ে লতা মঙ্গেশকর চলে গেলেন দূরের তারার পানে অমৃত লোকে। সেখানে চিরশান্তিতে থাকুন রূপকথার গানের পাখি লতাজি।
Discussion about this post