চট্টগ্রাম, ২০ মে, ২০২২:
আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাঙালির এক আলোকবর্তিকা নিভে গেল বলে নাগরিক সমাজ এক শোকসভায় বক্তব্যে বলেছে। আজ শুক্রবার (২০ মে) বিকেলে নগরীর সিআরবি চত্বরে নাগরিক সমাজ-চট্টগ্রাম শোকসভাটি আয়োজন করে।
নমস্য বাঙালি, কীর্তিমান সাংবাদিক, কলামনিস্ট, কবি ও লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী(৮৭) লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার, ১৯ মে স্থানীয় সময় ৬টা ৫৯ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেছেন। মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে রচিত অমর গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো /একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কী ভুলিতে পারি ” এর গীতিকার তিনি। এই গানটি বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের মধ্যে তৃতীয় গান হিসাবে বিবিসির শ্রোতারা স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
সাংবাদিকতা পেশার মধ্য দিয়ে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর উত্থান। ১৯৪৭ সালে তিনি কংগ্রেস নেতা দুর্গা মোহন সেন সম্পাদিত ‘কংগ্রেস হিতৈষী’ পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। ঢাকায় দৈনিক ইনসাফে উনিশশো পঞ্চাশের দশকের সাংবাদিকতা করেন তিনি। পরে সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেন দৈনিক সংবাদ, মিল্লাত, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক জনপদসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের মুখপাত্র ‘জয়বাংলা’ দায়িত্বে ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। লন্ডনে তিনি ‘নতুন দিন’ নামে একটি বাংলা পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
রাজনীতির মধ্য দিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। মূলত বঙ্গবন্ধু, ৫০ দশকের ছাত্ররাজনীতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীন বাংলাদেশ এবং ৭৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা এবং পরবর্তিতে প্রবাস জীবন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর চিন্তা চেতনাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিল। এতে তার সাংবাদিকতা ও লেখক জীবন ব্যাপক পরিসরে বিস্তার লাভ করে। কারণে তিনি হয়ে উঠেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেকুলার বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের প্রতিভূ। দেশ স্বাধীনের পর ৭৫ িএর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রবাস জীবনে তিনি রাজনৈতিক কলাম লিখে সবচেয়ে বেশি সুখ্যাতি লাভ করেন। লেখালেখির মাধ্যমে তিনি তার উদার চেতনাবোধ বাংলাদেশের কয়েকটি প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চালিত করেন। লেখক হিসেবে, যদিও তার লেখা কলামের যেমন ছিল বহু অনুরাগী পাঠক, আবার এসব কলামে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের অনেক প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য এবং বিবরণের জন্য তুমুল আলোচিত হতেন তিনি। তিনি তার গ্রন্থ ইতিহাসের রক্ত পলাশে লিখেছেন, ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৬ সালে যুক্ত নির্বাচন প্রথা সমর্থনে আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচনি লড়াই তিনি অগ্রভাগে ছিলেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৩৪ সালে ১২ ডিসেম্বর আবদুল গাফফার চৌধুরীর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থানার উলানিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ত গ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম জোহরা খাতুন। বাবা ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী। বাবা ছিলেন রাজনীতি সচেতন এবং ব্রিটিশশাসিত ভারতের কংগ্রেস নেতা। তার পিতা কংগ্রেস নেতা মতি লাল নেহেরুর সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স পাস করেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাস খানেক আগে তিনি বিদেশ যান তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি আর দেশে ফিরে আসেননি। পরে লন্ডনে নিজকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নানা ভাবে সংগ্রাম করেন। বিশেষ করে অর্থি
ক সঙ্মূগতি ফেরাতে তিনি মুদির দোকানেও কাজ করেন। পরে কিছুটা অবস্থা ফিরে আসলে তিনি লেখালেখি ও সাংবাদিকতায় মনোযোগ দেন। মূলত এ সময় তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কলাম লিখে সেকুলার বাঙালিদের মন জয় করেন। তার লেখার অসংখ্য পাঠক ও ভক্ত তৈরি। এই সুবাদে তিনি বাঙালি মনে জায়গা করে নেন।
তার সুলিখিত বহু গ্রন্থ রয়েছে। সরকার তাকে স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেছে।
এদিকে লন্ডন থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর লাশ দেশে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জানা গেছে সংবাদ মাধ্যমের খবরে। দেশের মাটিতে তার মরদেহ সৎকার করা হবে।
এদিকে নাগরিক সমাজ-চট্টগ্রাম এর শোক সভায় বক্তারা বলেছেন, গাফফার চৌধুরী ছিলেন বাঙালির আলোর পথের দিশারি, বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিচ্ছবি। একাধারে ছিলেন জাঁদরেল সাংবাদিক, কবি, লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দার্শনিক।’
সংগঠনের কো-চেয়ারম্যান মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শোকসভায় বক্তারা আরও বলেন, আবদুল গাফফার চৌধুরী সর্বদাই ছিলেন প্রগতিশীল শক্তির অগ্রগামীদের একজন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় যেমন লিখেছেন কালজয়ী গান, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্পাদনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র জয়বাংলা পত্রিকা। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর আকর্ষণ পাঠকদের মোহমুগ্ধ করে রাখত। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর একজন প্রিয়পাত্র ছিলেন।
বক্তারা আরও বলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় দিকনির্দেশনা মূলক কলাম লিখে গেছেন। লেখার ব্যাপারে তিনি নিরপেক্ষ থাকতেন। দলকানা মনোভাব তার সাংবাদিকতায় পরিলক্ষিত হয়নি কখনও। তার মৃত্যুতে বাঙালি জাতি এক সূর্য সন্তানকে হারালো।
শোক সভায় বক্তব্য রাখেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, জাসদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জসিম উদ্দিন বাবুল, বিএফইউজে’র যুগ্ম মহাসচিব মহসীন কাজী, খেলাঘরের সংগঠক বনবিহারী চক্রবর্তী, মোরশেদুল আলম, শিল্পী নারায়ন দাশ, মোরশেদ আলম, সাবের হোসেন, আবদুল মজিদ বিপ্লব, জায়দীদ মাহমুদ ও সুনীল দাশ।
Discussion about this post