০১.
কাউকে সত্যিকারের শুদ্ধ, সংশোধন ও সৃষ্টিশীল করতে চাইলে, তাকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। কাজ ছাড়া খালি জ্ঞান দান ও ক্রমাগত উপদেশ-নসিহতে মানুষের শুদ্ধতম পরিগঠন সম্ভব না।
ইসলাম ধর্ম মতে প্রত্যেকটা মানুষের সাথে একজন করে শয়তান থাকে। এখন যাকে উপদেশ, নসিহত ও জ্ঞান প্রদান করা হচ্ছে—সাথে থাকা সেই শয়তান ঐসমস্ত উপদেশ, নসিহত, জ্ঞান ইত্যাদি ভলি(volley) বলের মতোন মাথার উপর দিয়ে ছুঁড়ে দিতেই পারে। দেয়ও—কারণ শয়তানের কাজই তাই।
এজন্য উত্তম কৌশল হচ্ছে: উপদেশ, নসিহত ও জ্ঞানের বিষয়বস্তুকে শুধু ‘দান ও প্রদান’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে কাজ বা আমলে পরিণত করা।
সমাজ, বাস্তবতা ও গণ-মানুষের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার বিষয়বস্তুকে কাজে পরিণত না করার কারণেই দেখা দিয়েছে উপযুক্ত শিক্ষার অভাবজনিত ‘বৃহত্তর সংকট’—অনিয়ন্ত্রিত ও অবিকশিত একটা প্রজন্ম তৈরি হয়ে গেছে।
০২.
আধুনিক বিশ্বে শিক্ষা ও সভ্যতায় অগ্রসর রাষ্ট্রগুলোর শিক্ষার্থীদের শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে কাজের মাধ্যমে।
সেইসব উন্নত রাষ্ট্রের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মনোযোগের মূল ফোকাস বিন্দুটা থাকে তাদের ওপর অর্পিত কাজে। আর শিক্ষকের নজরদারি থাকে ‘শিক্ষার্থী’ ও ‘অর্পিত কাজ’—উভয়ের ওপর।
আমরা বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিক্ষকরা মনে করে থাকি যে, সমস্ত শিক্ষার্থীদের মনোযোগের ফোকাস বিন্দুটা ঠিকরে পড়বে শিক্ষকের ওপর। শিক্ষার্থীরা মন দিয়ে শিক্ষকদের কথা শুনে যাবে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো- শিক্ষার্থীদের মনো-সংযোগের অখণ্ড ফোকাস বিন্দুর অধিকাংশই ক্ষয়ে যায় প্রতিদিনকার প্রাইভেট, কোচিং, হোমটিউটর এবং বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাসে। একটা পর্যায়ে তো শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ও ধৈর্যচ্যুতির ঘটনা ঘটতেই পারে। ঘটেও। আর কতো! তখন শিক্ষকরা ধমক-ধামক দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে থাকেন। আরও দ্রুত ফল লাভের জন্য এখন কেউ কেউ চাচ্ছেন—আচ্ছা-মতন বেতানোর সোনালী দিন ফেরত পেতে!
আমরা বাচ্চাদের মাইর দিয়েই মাইর শেখাই। কোনো মানব সন্তানই মায়ের পেট থেকে হাত পাকায়ে আসে না। বাস্তবতা অনেক পাল্টেছে। আগের সেই বাস্তবতা নাই। বুঝতে হবে।
০৩.
বাচ্চাদের মধ্যে সামাজিকীকরণ ও দেশ-রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা জাগাতে হলে অবশ্যই পাঠের বিভিন্ন বিষয়বস্তুকে সমাজের সাথে যুক্ত করে শিক্ষার্থীদের দিয়ে কাজ করায়ে নিতে হবে। এইসব কাজের ধরনধারণ নিয়েই মূলতঃ গড়ে ওঠেছে প্যাডাগোজি বা শিক্ষণ বিজ্ঞান।
প্যাডাগোজি বা শিক্ষণ বিজ্ঞানের আভিধানিক অর্থ হলো—’শিখনের বিজ্ঞানসম্মত শৈল্পিক উপায়’। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের পাঠকার্যক্রম হবে বিজ্ঞানভিত্তিক, এবং তাতে থাকবে শিল্প।
বিজ্ঞান ও শিল্প। মোটাদাগে বিজ্ঞান হলো ‘গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ’ আর শিল্প হলো ‘আনন্দ’।
সার কথা হলো: পাঠের বিষয়বস্তুকে সমাজবাস্তবতার সাথে মিলিয়ে যেইসব কাজ শিক্ষার্থীরা করবে—তা হবে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণমূলক—যাতে থাকবে অপার আনন্দ ও বিনোদন।
০৪.
প্যাডাগোজির উদাহরণ হিশাবে আমরা পেশ করতে পারি জন ডিউই-এর ‘সমস্যা সমাধান’ ও থর্ণ ডাইকের ‘প্রচেষ্টা ও ভুল সংশোধন’ পদ্ধতির কথা।
‘সমস্যা সমাধান’ ও ‘প্রচেষ্টা-ভুল সংশোধন’—এই দুই পদ্ধতির আলোকে উইলিয়াম হার্ড কিলপ্যাট্রিক প্রস্তুত করেন দুর্দান্ত এক পদ্ধতি, তার নাম—’প্রজেক্ট পদ্ধতি’।
আমাদের ২০১২-এর শিক্ষানীতিতে খাস করে উল্লেখ করা হয় ‘সামাজিক গঠনবাদ’-এর কথা। সামাজিক গঠনবাদ, অর্থাৎ পাঠের বিষয়বস্তুকে বায়বীয় না করে সমাজবাস্তবতার সাথে যুক্ত করে শিক্ষার্থীদের শিখন সম্পন্ন করতে হলে ‘প্রজেক্ট পদ্ধতি’ খুব দরকারী একটা জিনিস।
০৫.
প্রজেক্ট পদ্ধতির মৌলিক ভিত্তি হলো:
ক. করে শেখা
খ. জীবন থেকে শেখা এবং
গ. পরস্পরের সহযোগিতায়, মিলেমিশে একসঙ্গে কাজের মধ্য দিয়ে শেখা।
ফ্রান্সের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জে. ডেলরস, যিনি একসময় ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালে ইউনেস্কোর নিকট শিক্ষা বিষয়ক একটা প্রবন্ধ জমা দেন, যার শিরোনাম ছিলো—’লার্নিং: দ্য ট্রেজার উইদিন’। সেখানেও তিনি ঘুরিয়েফিরিয়ে প্রজেক্ট পদ্ধতির কথাই বলেছেন।
ডেলরস শিক্ষার চারটি স্তম্ভের কথা বলেন:
ক. জানতে শেখা
খ. করতে শেখা
গ. হাতে শেখা এবং
ঘ. একসঙ্গে মিলেমিশে থাকতে শেখা।
প্রজেক্ট পদ্ধতির মৌলিক ভিত্তি এবং ডেলরসের চারটি স্তম্ভ মূল্যায়ন করলে, এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে কাজ ছাড়া শিখন সম্পন্ন হয় না; এবং শিক্ষার একটা অভীষ্ট লক্ষ্য হলো—’সামাজিকতা’।
০৬.
প্রজেক্ট পদ্ধতিতে শিক্ষককে অবশ্যই পাঠের বিভিন্ন বিষয়বস্তুর আলোকে শিক্ষার্থীদের সামনে বিবিধ সামাজিক সমস্যা তুলে ধরতে হবে—শিক্ষার্থীরা একক বা দলগতভাবে পছন্দসই কোনো একটা সমস্যা বেছে নিয়ে সমাজের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়বে।
তারপর, শিক্ষার্থীরা মানুষের সাথে মিশবে। তথ্য সংগ্রহ করবে। সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ যাচাই-বাছাই করবে। ভুল হলে আবারও সমাজের কাছে যাবে। প্রয়োজনীয় মানুষের সাথে কথা বলবে। সংশোধন করে নেবে।
সবশেষে, সমস্যা সমাধানের একটা প্রকল্প তৈরি করে তা প্রতিবেদন আকারে শিক্ষকের নিকট জমা দেবে। সেইটা নিয়ে শিক্ষক আলাপ করবেন। প্রয়োজনীয় সংশোধনী দেবেন।
এখন, এইভাবে যদি সমাজের সাথে যুক্ত করে পাঠকার্যক্রম সঞ্চালিত হতে থাকে; তাহলে বাচ্চাদের মধ্যে একটা পর্যায়ে সামাজিকীকরণ ঘটে যেতে বাধ্য। তাছাড়া ঘুরতে-ফিরতে সমাজের নানা মানুষ, ঘটনা ও অভিজ্ঞতার সাথে বাচ্চাদের পরিচয় ঘটবে—যা তাদের মজাও দেবে।
যেমন ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার আলোকে শিক্ষক সমস্যা দেখালেন—”সমাজের যারা প্রতিপত্তি ও অর্থবিত্ত ধারণ করে থাকে, তাদেরই কারো কারো দ্বারা সমাজের ন্যায়বিচার বিনষ্ট হয় এবং সাধারণ মানুষ জুলুমের শিকার হয়”—এই সমস্যার সমাধান কল্পে শিক্ষার্থীরা সরেজমিনে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে একটা প্রজেক্ট বা প্রকল্প তৈরির কাজ করবে, যা হবে সৃজনশীল ও রোমাঞ্চকর।
০৭.
আমাদের বিরাজমান সমাজবাস্তবতায় শিক্ষার্থীরা কী কাজ করে থাকে?
প্রাইভেট, কোচিঙ ও স্কুলে যায়। শিক্ষকের প্রদেয় বিদ্যা আহরণ করে। বাসাবাড়িতে হোমটিউটরের কাছ থেকে বিদ্যা গেলে। আর পরীক্ষা দেয়।
উক্ত কাজে শিক্ষার্থীদের তথ্যমূলক জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। অবশ্যই ঘটে। অর্থাৎ উগান্ডার রাজধানীর নাম কী, বিশ্বের কোন হ্রদের পানি মিঠা, রেহানা মরিয়ম নূর ছবির পরিচালক কে, ইত্যাদি—এই মার্কা। কিন্তু শিক্ষার যে আরও দুইটা উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র, যেমন: চিত্তশুদ্ধি বা মানব মনের প্রকর্ষ এবং সৃষ্টিশীল কর্মের বিকাশ ঘটছে না।
জ্ঞানমূলক ক্ষেত্রের বিকাশের জন্য প্রাইভেট ও কোচিঙের অপরিসর কক্ষই যথেষ্ট। বিদ্যালয়গুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যা করছে, দিনশেষে তা একরকম অলস কোচিঙ সেন্টারের মতোই—কিছু জ্ঞান বিতরণ করে যাচ্ছে মাত্র!
শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ সম্পন্ন ও সৃষ্টিশীল কর্মমুখী মানুষ বানাতে চাইলে, তাদেরকে অনিবার্যরূপে সমাজের সাথে যুক্ত করে শেখাতে হবে। যে ছেলে সাইকেল চালাতে জানে না, তার সামনে একখানা সাইকেল হাজির করে যতোই তত্ত্ব ও তথ্য পরিবেশন করা হোক না কেনো; মাঠে না নিলে কস্মিনকালেও ঐ ছেলে সাইকেল চালানো শিখবে না। এটাই বাস্তবতা।
০৮.
বিদ্যালয়ের ভূমিকা ছাড়া বাচ্চাদের সমাজের সাথে যুক্ত করে পাঠদান সম্ভব নয়। কথা হলো বিদ্যালয়গুলো এই ভূমিকাতে নেই কেনো? এর উত্তর বেশ দীর্ঘ। সংক্ষেপে:
★ কারিকুলাম ও বইপুস্তক যুগোপযোগী না।
★ আধুনিক ও মানসম্মত পর্যাপ্ত বিদ্যালয় এবং যথাযোগ্য শিক্ষক নাই।
★ শিক্ষকদের নড়বড়ে বেতন কাঠামো।
★ অভিভাবকদের পরিবর্তিত ও ক্ষেত্র বিশেষে বিকৃত মানসিকতা।
★ উৎপাদিত শিক্ষকের ব্যবস্থা না রেখে, চাকরি খুঁজতে এসে শিক্ষক—এই নীতি অবলম্বনে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া জারি রাখা।
★ কোনো একটা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের পূর্বে মাঠপর্যায়ের হালহকিকত সম্পর্কে সম্যক ধারণা না রাখা। ইত্যাদি…
শিক্ষার সমগ্র সিস্টেম তৎপর হলেই কেবল পাঠের বিষয়বস্তুকে সমাজের সাথে যুক্ত করে কোনো একটি সমস্যা নিয়ে সানন্দে গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের কাজ চলিয়ে যাওয়া সম্ভব।
শিক্ষা এমন একটা জিনিস, যার সমগ্র সিস্টেমের A to Z কোথাও সামান্যতম ছিদ্র রাখা যাবে না; রাখলেই ঐ ছিদ্র পথে একেকটা দানব বেরিয়ে আসবেই!
০৯.
গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ—শব্দ দুটি ওজস্বী। বেশ ভারি মনে হয়। তা হোক। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বেলায় তা হবে বিনোদনের মোড়কে। এজন্যই বিবিধ শিখন পদ্ধতি বা প্যাডাগোজি উদ্ভাবিত হয়েছে।
যেমন: একটা বাচ্চা ছবি আঁকে নিজের মনের গরজে। মনের আনন্দে। অথচ সেখানে অবধারিত ভাবে কাজ করে ‘গবেষণা’ ও ‘পর্যবেক্ষণ’—রেখা স্থাপন, চিত্রের বিন্যাস, রঙের মিথস্ক্রিয়া ইত্যাদি।
শিক্ষার্থীদের বিনোদনের খুব দরকার। সারাদিন প্রাইভেট, কোচিঙ, বিদ্যালয়, হোমটিউটর—বিনোদনের অফুরন্ত সুযোগ কোথায়? বিষয়টা ভয়াবহ ও বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
একসময় বাংলা ফিল্মে ঢুকে পড়েছিল খোলামেলা যৌনতা। অশ্লীলতা। সেইটা উপভোগ করতে যেতো সারাদিনের খেটে খাওয়া মানুষরা, যাদের ক্লান্ত শরীর ও শ্রান্ত মন শৈল্পিক বিনোদন আস্বাদনের ধৈর্য্য রাখতো না—অতএব, যৌনতা!
লাগাতার বিনোদন বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের বেলাতেও তাই হয়েছে—অতএব, যৌনতা!
খবরে যা পেলাম তাতে আমার মনে হয়েছে উৎপল স্যারের হত্যাকাণ্ডের সাথে ঐ ‘অতএব, যৌনতার’ একটা সম্বন্ধ আছে।
১০.
এখনকার প্রজন্ম হয়তো অনেক কিছুই জানে। কিন্তু সমাজ সম্পৃক্ত হৃদয়বৃত্তি ও সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা চর্চার অভাবে তারা খুব কমই জানে যে, একটা কাজ শুরু করে কীভাবে তার নান্দনিক ও সফল পরিসমাপ্তি ঘটাতে হয়। জানে না। ফলে, তারা তাদের সহপাঠীকে খুন করে। শিক্ষককে হত্যা করে। তাদের হাতে মা-বাবা লাঞ্ছিত হয়। তারা নিজেরাও নিজেদের হত্যা করে থাকে।
নান্দনিক ও সফল পরিসমাপ্তির সূক্ষ্ম ভাবনা আমাদের বড়োদের কজনারই বা আছে?
অর্থবিত্ত ও প্রতিপত্তির পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা বড়োরা ভুলেই বসে আছি যে কখন, কোথায়, কীভাবে থামতে হবে—আসল ট্র্যাজেডি এটাই।
খামোখা পোলাপানদের দোষ দিয়ে কী লাভ!
লেখক পরিচিতি: খোন্দকার কাওসার আহমেদ, শিক্ষক,পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
Discussion about this post