চট্টগ্রাম, ২২ নভেম্বর, ২০২২:
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলার দুর্গম, অনগ্রসর এলাকায় প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি, কিশোর-কিশোরী, নারী স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, পানি ও পয়ঃব্যবস্থা, নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধসহ শিশুশ্রম ও নির্যাতন প্রতিরোধ এবং নানা সামাজিক সেবা দেওয়াই হচ্ছে পাড়া কেন্দ্রের কাজ। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকাংশ মানুষ দুর্গম এলাকায় বসবাস করে। সেখানে মৌলিক সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো ছিল দুরূহ। যে কারণে পাড়াকেন্দ্রগুলো দুর্গম এলাকায় ব্যাপক আলো ছড়ায়।
আশির দশকের পর থেকে পাহাড়ের সেসব প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুদের কাছে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছে ‘পাড়াকেন্দ্র’। বান্দরবানে এ প্রকল্প চালু হয় ১৯৯৬-৯৭ সালে।
বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলায় ৪ হাজার ৮শ পাড়াকেন্দ্রে ৫৭ হাজার ৭শ ২৬জন শিশু প্রাক শিক্ষা নিচ্ছে। এর মধ্যে বান্দরবান জেলায় ১ হাজার ৩শ পাড়াকেন্দ্রে প্রাক শিক্ষার্থী রয়েছে ১৯ হাজার ৪০০জন। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলায় ৪ হাজার ৮শ পাড়া কর্মী এবং ৪শ ৮০জন মাঠ সংগঠক এসব সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু এখন এসব পাড়াকেন্দ্র বন্ধ করার কথা শোনা যাচ্ছে।
এলাকার সেবা গ্রহীতারা বলছেন, মাঝপথে এর কার্যক্রম থেমে গেলে পার্বত্য জেলার দুর্গম ও দরিদ্র এলাকায় প্রাক শিক্ষা ও আর্থ সামাজিক সেবা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে পাহাড়ে বসবাসরত মানুষ বিশেষ করে শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন পাড়াকর্মীরা। পাড়া কেন্দ্রে আসা ৩ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের যতœ ও প্রাক-শিক্ষাদান, গর্ভবতী ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ দেওয়া, প্রত্যক্ষ পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালনা, স্বল্পব্যয়ে যথোপযুক্ত পদ্ধতি প্রদর্শন ও প্রশিক্ষণ দেওয়া, শিশু সুরক্ষা, শিশু ও নারীর অধিকার নিয়ে ধারণা দেওয়ার মতো কাজগুলো পরিচালনা করা হয়ে থাকে। এছাড়া কমিউনিটি সদস্যদের আচরণগত পরিবর্তন, কমিউনিটির হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণ, কমিউনিটি সভা করা, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সামাজিক কাজও চালানো হয় এসব পাড়া কেন্দ্র থেকে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, পাংখোয়া, লুসাইসহ ১৪টি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর বসবাস। এসব জনগোষ্ঠীর শিশুদের নিজেদের মাতৃভাষার পাশাপাশি খেলাধুলার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার কাজ করছে পাড়াকেন্দ্রগুলো। নিজেদের ভাষার পাশাপাশি এসব শিশুদের নানাবিধ মৌলিক সুবিধাসহ মাঠ সংগঠক ও পাড়া কর্মীরা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। যেসব এলাকায় এখনো পর্যন্ত কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেনি সেসব জায়গায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাঙালি ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিশুদের প্রাক-শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ি পরিদর্শন ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দেন কর্মীরা।
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই, রুপসীপাড়া, লামা সদর ও আজিজনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় পাড়াকেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, সকাল ৯টা থেকে শিশুদের কোলাহলে মেতে উঠে এখানকার পাড়া কেন্দ্রগুলো। কোমলমতি শিশুদের সঙ্গে করর্মদন ও বুকে জড়িয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করান পাড়াকর্মীরা। এরপর কেউ বিভিন্ন খেলার সামগ্রী নিয়ে খেলছে, কেউ ছড়া আবৃত্তি করছে, আবার কেউ গানে গানে নৃত্য করছে। এতে আনন্দ-উচ্ছাসে মেতে উঠা শিশুরা। কেন্দ্রগুলোতে দেখা গেছে, শিশুদের উৎসাহব্যঞ্জক পাঠদান। একই চিত্র জেলার আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, থানচি, রুমা, রোয়াছংড়ি ও বান্দরবান সদর উপজেলার পাড়াকেন্দ্রগুলোতেও।
সরই ইউনিয়নের ফিল্ড অর্গানাইজার (এফও) নাছিমা আক্তার নীলিমা জানান, পাড়াকেন্দ্রেগুলো পরিদর্শনের পাশাপাশি উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গর্ভবতী ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন তারা। সরই ইউনিয়নের ফিল্ড অর্গানাইজার (এফও) মো. ইসমাইল হোসেন জানান, পাড়া কেন্দ্রে আসা ৩ থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের যতœ ও প্রাক-শিক্ষাদান শেষে তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হয়। তবে আমার আওতায় ১২টি কেন্দ্র রয়েছে সবগুলো কেন্দ্র পরিদর্শন এলাকায় উঠান বৈঠকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্য বিয়ে প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে সামাজিক পরিবর্তনে মানুষকে সচেতন করা হয়।
আজিজনগর ইউনিয়নের ফিল্ড অর্গানাইজার (এফও) রিজওয়ানা জানান, টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় ১১টি পাড়াকেন্দ্র মধ্যে ১ হাজার ৯২টি পরিবার রয়েছে এসব পরিবারগুলো প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এর বাইরেও আজিজনগরের দুর্গম এলাকায় গিয়ে পাড়া কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করে থাকি এবং পাঠদানে পাড়াকর্মীদেরকে পরামর্শ দিয়ে থাকি। মাসে দুইটা উঠান বৈঠক করা হয়। বৈঠকে তিনটি বিষয় আলোচনা করা হয় যেমন, শিশু বিকাশ, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়। বিষয়গুলো নিয়ে বৈঠকে সবাইকে ধারণা দেওয়া হয়। বিভিন্ন পাড়াকেন্দ্রের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীদের মতে, সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত শিশুদের পাঠদান এবং ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত কেন্দ্রের আশপাশের গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, পুষ্টি বিষয়ে শারীরিক খোঁজ খবর নিয়ে থাকেন তারা। কেন্দ্রগুলোতে ৩-৫ বছরের শিশুদের নিয়ে আদর-যতœ, লালন-পালন, স্বাস্থ্য সেবা, জাতীয় সঙ্গীত ছেলে মেয়েদেরকে শিখানো হয়। আর শিশুরা স্কুলে আসতে আগ্রহী। অভিভাবক ছাড়াই স্কুল খোলার আগেই চলে আসে ছেলেমেয়েরা।
অন্যদিকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও অভিভাবকদের মতে, পাড়াকেন্দ্রে শুধু প্রাক শিক্ষা প্রদান করা হয় না, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এখানে উঠান বৈঠক করা হয় নিয়মিত। একজন শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য তৈরি করে এই পাড়াকেন্দ্র্র। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুরা যা পড়ে, তা পাড়াকেন্দ্রের শিশুদের নিজেদের মাতৃভাষার মাধ্যমে পাড়ানো হয়। এতে করে শিশুদের মধ্যে স্কুল ভর্তি করা হলে ভয়-ভীতি আর থাকে না এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাটা সহজতর হয়ে ওঠে। তবে এই প্রকল্পটি স্থায়ীকরণের জন্য এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দাবি জানিয়েছেন।
লামা উপজেলা প্রকল্প ব্যবস্থাপক রেজাউল হক জানান-পাড়াকেন্দ্রেগুলোর মাধ্যমে শুধু শিক্ষা দানই নয়। টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকার জনগোষ্ঠির আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, মৌলিক সেবার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ এবং মা ও শিশুদের জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে আসছে পাড়াকর্মীরা।
টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের বান্দরবান জেলা প্রকল্প ব্যবস্থাপক আলু মং মার্মা জানান,পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের টকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের আওতায় বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলার চার হাজার ৮শ পাড়া কেন্দ্র এবং ৫৭ হাজার ৭শ ২৬জন শিক্ষাথী রয়েছে। শিশুদের নানাবিধ মৌলিক সুবিধাসহ ৪শ ৮০জন মাঠ সংগঠক এবং ৪ হাজার ৮শ পাড়া কর্মীরা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে এই মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা ২৮টি পাড়াকেন্দ্রে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু হয়েছে এবং অন্যান্য পাড়াকেন্দ্রগুলো ডিজিটালের আওতায় চলে আসবে। তবে চলমান প্রকল্পটি ২৩ সালের জুনে মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পটি যাতে চলমান থাকে সেজন্য ইতোমধ্যে ডিপিপি তৈরি করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বান্দরবান জেলার টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্প ব্যবস্থাপক আলু মং বলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে এ প্রকল্পটি ছিল। সেবা কার্যক্রম সম্প্রসারিত করে ২০১৮ সাল থেকে প্রকল্প আরো কার্যকর করা হয়। ২৩ সালে আমাদের বর্তমান প্রকল্প শেষ হবে। কোভিডের কারণে প্রকল্প নবায়ন করার কাজ দ্রুত সম্পন্ন না হওয়ায় এই প্রকল্প বন্ধ হতে পারে বা নবায়ন করতে বেগ পেতে হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে আরও বলেন, আমরা এই প্রকল্পের আওতায় সামাজিক পর্যায়ে ৭টি কাজ করি। এগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পয়োঃনিষ্কাশন, শিশু সুরক্ষা সহ বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজ তাদের আওতাভুক্ত। এর সাথে ১২ শিক্ষার্থির দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন বাবত কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করে। তাদের পড়ালেখা অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। অন্যদিকে পাড়াকেন্দ্রের কাজ বন্ধ হলে দুর্গম এলাকার সামাজিক অগ্রগতিন সূচক ব্যাহত হবে। একই সাথে তাদের পাড়া কর্মি সহ প্রকল্পের সাথে যুক্ত চাকরিজীবী আছে, তাদের আয়-রোজগার বন্ধ হলে অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি হবে।
তিনি প্রকল্পটি নবায়ন করার ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন বলে জানান।