চট্টগ্রাম, ১০ অক্টোবর, ২০২১
আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস।গত প্রায় ২ বছর ধরে করোনা ভাইরাসে শুধু শারীরিক অসুস্থতার সঙ্কটে পড়েনি মানুষ। এই করোনা সংক্রমণ মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যাও বাড়িয়ে তুলেছে। আর বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ করোনায় হারিয়েছে স্বজন-পরিজন। ইতিমধ্যে করোনায় সারা বিশ্বে মারা গেছে ৪৮ লাখ ৬২ হাজার মানুষ। আর সারা বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে ২৩ কোটি ৮৩ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ। করোনাক্রান্ত মানুষ ও স্বজন হারানো মানুষ যেমন মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে- তেমনি করোনাকালীন স্বাস্থ্য বিধি নিষেধের মধ্যে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি ব্যাপক মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে সব বয়সী মানুষের। এই আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে পোর্টসিটি লিঙ্কের বিশেষ আয়োজন ‘করোনা মহামারিতে নতুন মানসিক সমস্যাগুলোর কারণ কি’?
লিখেছেন- ধ্রুব রজক
নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিতে সারা পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে নতুন মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আতঙ্ক, মৃত্যুভয়, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে অস্থির মানুষ। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ কারণে শিক্ষার্থীরাও ছিল ভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি। প্রায় মানুষ ছিল আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব বিচ্ছিন্ন। শুধু কোভিড আক্রান্তরাই নয়, যারা এই রোগে আক্রান্ত হননি তাদের মাঝেও বাড়ছে মানসিক নানা সমস্যা। কোভিডে অর্থনৈতিক স্থবিরতা ছিল মারাত্মক। এজন্য হতাশা, উৎকণ্ঠা সহ নানা মানসিক সঙ্কটে ছিল নিম্ন আয়ের মানুষ।
যারা কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছেন তাদের মাঝেও দেখা দিচ্ছে নানা রকম মানসিক সমস্যা। এর ফলে সামাজিকভাবেও দেখা যাচ্ছে নানা রকমের বিশৃঙ্খলা। কোথাও কোথাও খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ব্যক্তিবিশেষে কোভিডের মানসিক প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন ভিন্ন। অন্যদিকে মানুষের জীবনের এই সঙ্কট প্রভাবিত করেছে প্রাণিকূলকে।
করোনা (কোভিড-১৯) একটি ভাইরাসজনিত রোগ হলেও রোগটির ব্যাপ্তি এতই বেশি যে তা শারীরিক স্বাস্থ্যের বিপন্নতাকে অতিক্রম করে মানসিক, সামাজিক আর অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের বিপর্যস্ত করে ফেলছে।
এমনকি এই সময়ে মানুষের মধ্যে বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতাও। গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার শুরুর সময় করোনাজনিত আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ে ৫ শতাংশ। এপ্রিল মাসে অর্থাৎ একমাস পরে এই ঝুঁকি বাড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এপ্রিল-মে মাসে ঝুঁকি বাড়ে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ এবং জুলাইয়ে গিয়ে আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ে ১৯ শতাংশ। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ-এ আত্মহত্যার প্রবণতা কিছুটা কমে আসে।
করোনাকালে আত্মহত্যার কারণ উল্লেখ করে বলা হয়, পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩৫ শতাংশ। এর বাইরে ২৪ শতাংশ সম্পর্কে টানাপোড়েনের কারণে এবং অজানা কারণে ৩২ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। আর্থিক ও লেখাপড়ার কারণে আত্মহত্যা করেছেন যথাক্রমে ৪ ও ১ শতাংশ।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন করোনাভাইরাস সংকটের সময় মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে। চিকিৎসকরাও চেষ্টা করেছেন মানুষকে পরামর্শ দিতে। কিন্তু সহযোগিতার চেষ্টা করা হলেও তা সর্বত্র সবার কাছে পৌঁছেনি।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক চাপের বিষয়টি একেক জনের ভেতর একেক রকমভাবে কাজ করে। যখন কোন সংকটের মধ্যে আমরা পড়ি, তাতে একেকজন মানুষ একেকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়।
‘ তারা বলছেন, কোভিডে কিছুটা ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। খানিকটা উদ্বিগ্নতার উপকারও আছে। সেটা আমাদের সচেতন হতে সহায়তা করে, নিজেদের রক্ষা করতে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে।’
কিন্তু উদ্বিগ্নতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়, মানুষ যখন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তখন তাদের মধ্যে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
করোনার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের বিপন্নতার সম্পর্ক এখন সর্বজনস্বীকৃত। এমনকি সেপ্টেম্বর ২০২০-এ ল্যানসেটের সম্পাদক ড. রির্চাড হর্টন তার ‘কোভিড-১৯ ইজ নট অ্যা প্যানডেমিক’ শীর্ষক বিশেষ নিবন্ধে বলেছেন, কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অতিমারি বা প্যানডেমিক নয়, বরং এটি সিনডেমিক। কমপক্ষে দুই ধরনের রোগ বা সমস্যা যদি মহামারি (এপিডেমিক) হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কোনো বিপুল সংখ্যক মানুষের স্বাস্থ্যের (স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য) ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তবে তাকে সিনডেমিক বলা যায়। মহামারির কারণে আর্থ-সামাজিক বড় ধরনের পরিবর্তনও সিনডেমিক হতে পারে।
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে করোনায় সংক্রমিত মানুষের প্রতি পাঁচ জনের একজনের মধ্যে করোনার সাথে মানসিক সমস্যা (বিষন্নতা, উদ্বিগ্নতা, সাইকোসিস ইত্যাদি) দেখা দেয়। আবার কোভিড সংক্রমিত নন এমন ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে স্ট্রেস উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা, প্যানিক অ্যাটাকের হার সাধারণ সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যায় বলে প্রমাণিত। এমনকি করোনা থেকে সেরে উঠলেও মানসিক সমস্যার ঝুঁকি কিন্ত থেকেই যায়। এপ্রিল ২০২১ এ ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় করোনা থেকে সেরে উঠার প্রথম ৬ মাসের মধ্যেই প্রতি ৩ জনে ১ জনের মধ্যে এমন মানসিক সমস্যা দেখা গেছে যেটার চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রায় ১৭শতাংশ-১৯শতাংশের মধ্যে অতি উদ্বেগ, ১৪ শতাংশের মধ্যে মুড ডিসঅর্ডার আর ১.৫ শতাংশ-২.৭ শতাংশের মধ্যে গুরুতর মানসিক রোগ (সাইকোসিস) দেখা গেছে। প্রায় ২ লাখ ৩৬ হাজার করোনা থেকে সেরে ওঠা মানুষের মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই গবেষণা চালানো হয়। করোনার মনোসামাজিক প্রভাব এত এত বেশি যে এটি প্যানডেমিককে অতিক্রম করে সিনডেমিক হয়ে উঠেছে।বাংলাদেশে ২০১৮ সালে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক জাতীয় জরিপে দেখা যায়, দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগের হার ১৮.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৬.৭ শতাংশ বিষণ্নতা আর ৪.৭ শতাংশ ছিল এংজাইটি সমস্যা। কোভিডকালে বাংলাদেশে পরিচালিত কিছু গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৩৩ শতাংশের মধ্যে অ্যাংজাইটি আর ৪৬শতাংশের মাঝে বিষন্নতার লক্ষণ পাওয়া গেছে।
অর্থাৎ সাধারণ সময়ের চেয়ে কোভিডকালে মানসিক সমস্যা বাংলাদেশেও বেড়ে যাচ্ছে। বিগত এক বছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যা ঘটেছে প্রায় চৌদ্দ হাজার যা বিগত বছরের চেয়ে বেশি। এছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে কোভিড ইস্যুতেই (কোভিড নিয়ে কুসংস্কার, স্টিগমা, কোভিডভীতি) প্রায় ৫ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক, চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, মরে যাবার ভয়, অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা, বেকারত্ব, এমন করোনা নিয়ে ভ্রান্ত-নেতিবাচক সামাজিক বৈষম্যের কারণে বাড়ছে মানসিক সংকট। আর করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে স্ট্রেস বার্নআউট হচ্ছে যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এমনকি করোনাকালে বিশ্বজুড়ে বেড়ে গেছে পারিবারিক সহিংসতা ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা।
প্রভাব পড়ছে শিশু-কিশোর আর তরুণদের ওপরেও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, জীবন যাত্রার রুটিন পরিবর্তন আর পরিবারে গুণগত সময় না পাওয়ায় তাদের মানসিক সুস্থতা বিঘ্নিত হচ্ছে, বাড়ছে অনলাইন আসক্তি আর আচরণজনিত সমস্যা। শিশু-কিশোর আর তরুণদের মধ্যে আবেগের উঠানামা, ভুলে যাওয়া, মনোযোগের অভাব, ভালো লাগার বিষয়গুলোও ভালো না লাগা, খিটখিটে মেজাজ, রেগে যাওয়া, আগ্রাসী আচরণ, নিজের ক্ষতি করা ও আত্মহত্যা প্রবণতা এবং ঘুমের সমস্যা উপসর্গ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে।