চট্টগ্রাম, ১৬ আগস্ট, ২০২২:
নগরের সিআরবি এলাকায় পিপিপির আওতায় হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে চট্টগ্রামের মন্ত্রী সাংসদরা রেলমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন। এর আগে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি হাসপাতালটি সীতাকুণ্ডের কুমিরায় স্থানান্তরের সুপারিশ করেছিল। তবে হাসপাতাল সরানোর ব্যাপারে যখন চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ আন্দোলন করে আসছিল, সেসময় চট্টগ্রামের বেশিরভাগ মন্ত্রী ও সাংসদদের আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা পোষণ করতে দেখা যায়নি। কিছুটা দূরে দেূরে ছিলেন অনেকেই। এখন সকলে মিলে রেলমন্ত্রীকে চিঠি দেওয়ায় নাগরিক সমাজ মনে করছে তাদের আন্দোলনের সুফল দেখা দিতে পারে।
পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেদন ও সর্বস্তরের মানুষের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত কালচারাল হেরিটেজ সিআরবিতে ইউনাইটেড হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়টি স্থগিতের জন্য রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজনকে অনুরোধ জানিয়েছেন চট্টগ্রামের মন্ত্রী ও এমপিরা। নেতৃবৃন্দ হাসপাতালটি রেলের অন্য জায়গায় নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়টি দ্রুত বাস্তবায়নেরও অনুরোধ জানান রেলমন্ত্রীকে। বিষয়টি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ নিশ্চিত করেছেন।
মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চট্টগ্রামের সাবেক ও বর্তমান তিন মন্ত্রী এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন- সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রমুখ। এছাড়া চিঠিতে ভুমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, হুইপ শামসুল হক চৌধুরী এমপি, মোছলেম উদ্দিন আহমেদ এমপি, মোস্তাফিজুর রহমান এমপি, মাহফুজুর রহমান মিতা এমপি, খাদিজাতুল আনোয়ার সনি এমপি স্বাক্ষর করেছেন।
চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক সিআরবি এলাকায় পিপিপির আওতায় হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পটি রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সীতাকুণ্ডের কুমিরায় স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়ায় রেলমন্ত্রী ও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অভিনন্দন জানানো হয় চিঠিতে।
চিঠিতে বলা হয়, আপনি জানেন প্রাচ্যের রানি হিসেবে খ্যাত সাগর, পাহাড়, নদীবেষ্টিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি আমাদের চট্টগ্রাম। নান্দনিক সৌন্দর্যে ঘেরা এ নগরের রূপ মাধুর্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত কেন্দ্রীয় রেলভবন তথা সিআরবি। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত সিআরবি ভবনটি শুধু চট্টগ্রামেই নয়, পুরো দেশের মধ্যে স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। এখানে রয়েছে- অসংখ্য রেইনট্রি। যেগুলোর কোনো কোনোটির বয়স পেরিয়ে গেছে শত বছরের বেশি। এটি ব্যস্ততম নগরী চট্টগ্রামের অক্সিজেন সরবরাহের উৎস হিসেবেও পরিচিত।
সম্প্রতি এক গবেষণায় সিআরবিতে প্রায় ২২৫টি দুর্লভ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। শতবর্ষী বৃক্ষরাজি, পাহাড়, টিলা ও উপত্যকায় ঘেরা বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান হিসেবে সিআরবি চট্টগ্রামের মানুষের মনে আলাদা স্থান করে নিয়েছে। এখানে বৃক্ষরাজির শীতল ছায়াতলে বিশেষ করে অনিন্দ্য সুন্দর শিরীষতলায় আয়োজিত হয় বাংলা নববর্ষ, বসন্ত উৎসব, রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তীসহ বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসমূহ।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদ হিসেবে আত্মোৎসর্গ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ। তিনিসহ ১১ জনের সমাধি রয়েছে এ সিআরবিতে। অপূর্ব নিসর্গ, শহীদদের সমাধিস্থল, মুক্তবায়ুতে নিরিবিলি পরিবেশে সকাল-বিকাল পরিবার পরিজন নিয়ে হাঁটাচলার এবং শারীরিক কসরতের অন্যতম নিরাপদ স্থান হিসেবে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে সিআরবি এখন অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ।
তারা বলেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে প্রণীত ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) এটিকে কালচারাল হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ৮টি নির্দেশনার উল্লেখ রয়েছে সিআরবির ব্যাপারে।
নির্দেশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে সিআরবির কোনো অংশ ব্যবহার না করা এবং কোনো বহুতল ভবন নির্মাণ না করা। শুধু পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পাখির অভয়ারণ্য, জাদুঘর, প্রজাপ্রতি উদ্যান প্রতিষ্ঠা করা যাবে। সব কিছু মিলিয়ে সিআরবি এখন চট্টগ্রামের সব মানুষের আবেগ ও ভালোবাসার জায়গায় পরিণত হয়েছে। এখানে হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগটি সংশ্লিষ্ট গেজেটের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন বলে তারা রেলমন্ত্রীকে জানান।
বর্তমানে হাসপাতাল স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়ায় চট্টগ্রামবাসী আশান্বিত হয়েছেন, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন।
রেলমন্ত্রীকে দেয়া চিঠিতে আরও বলা হয়, চট্টগ্রাম শহরে একসময় অনেক পাহাড়, দীঘি, পুকুর ছিল। ছিল শাল, রেইন ট্রি ইত্যাদি বৃক্ষ আচ্ছাদিত রাস্তা। ছিল বাটালি হিল, কাছারি পাহাড়। পাকিস্তান আমলে বাটালি হিল ধ্বংস করা হয়েছে। কাছারি পাহাড়ের ওপরও আঘাত হেনেছিল তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। এ কাছারি পাহাড়ের বিশাল অংশ কেটে তৈরি করা হয় নিউ মার্কেট, জেনারেল পোস্ট অফিস ও স্টেট ব্যাংক। এভাবেই চট্টগ্রামের নিসর্গ, সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে কালক্রমে। এখন অবশিষ্ট আছে শুধু সিআরবি।
পরিবেশ অধিদফতরও সেখানেহাসপাতাল নির্মাণ না করে পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে মতামত প্রদান করেছে।
ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের ব্যানারে হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প অন্যত্র স্থানান্তরের দাবিতে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ২০২১ সালের ২৬ আগস্ট তারা প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদন প্রেরণ করেন। ২০২১ সালের ৬ আগস্ট তারা আপনার বরাবরেও একটি আবেদন করেছেন। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় বেশ কিছু নিবন্ধ ও মতামত প্রকাশিত হয়েছে। চিঠিতে চট্টগ্রামের সকল জনসাধারণের পক্ষ হতে মন্ত্রী এমপিরা সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ স্থগিত করে রেলওয়ের অন্য জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান রেলমন্ত্রীকে। সূত্র: প্রেস বিজ্ঞপ্তি- তথ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা।
Discussion about this post